ইন্টারনেট গতির বৈশ্বিক সূচকে ১৪০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬তম। এক্ষেত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া ক্ষুধা, দারিদ্রপীড়িত দেশ সোমালিয়া ও ইথিওপিয়াও বাংলাদেশকে পেছনে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গতি ও সেবার মান সর্বনিম্ন। নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ারনমারও এগিয়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটরগুলোই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে (বিটিআরসি) প্রভাবিত করতে থাকে। যার ফলে সেবার মান ও গতি বাড়ে না। অবশ্য মোবাইল অপারেটরগুলো বলছে, ইন্টারনেটের গতি ও সেবার মান বাড়াতে যে পরিমাণ তরঙ্গ (স্পেকট্রাম) প্রয়োজন সেটা বিটিআরসি সরবরাহ করে না। এ নিয়ে মোবাইল অপারেটর, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার ও বিটিআরসির মধ্যে টানাপোড়েন রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম প্রধান সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান সার্ফশার্ক, বিটিআরসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।সূত্র জানায়, ডিজিটাল সেবায় এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। ডিজিটাল জীবনযাত্রার সূচকে ১১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৩তম। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও সবার নিচে। ডিজিটাল দেশ গড়ার ঢাকঢোল পেটালেও সেবার মান বাড়ে না বছরের পর বছর। মোবাইল ইন্টারনেট গতিতে ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৬তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে মালদ্বীপ। দেশটির অবস্থান ৪৫তম। এরপরই ৮৮তম স্থানে রয়েছে মিয়ানমার। নেপালের অবস্থান ১১৪তম। এর চার ধাপ পিছিয়ে ১১৮তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। ১২০তম অবস্থানে শ্রীলঙ্কা। ভারত ১৩১তম অবস্থানে। সবচেয়ে নিচে ১৪০তম অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান। মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ১৮৩ এমবিপিএসের বেশি। তার পরই রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, কাতার, চীন, সৌদি আরব, নরওয়ে, কুয়েত ও অস্ট্রেলিয়া।
ভুক্তভোগীদের বক্তব্য : বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা লুৎফর রহমান জানান, তিনি প্রতিদিন দুুপুরে পরিবারের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন। ইন্টারনেটের গতি এতটাই কম থাকে যে, সব সময়ই বাফারিং করে। তবে ব্রডব্যান্ড লাইনে কথা বললে কিছুটা ভালো সেবা পাওয়া যায় বলে তিনি মনে করেন। শুধু তাই নয়, প্রতি মাসে ইন্টারনেটের খরচও অনেক বেশি গুনতে হয়। এ ছাড়া মাস শেষে ক্রয়কৃত প্যাকেজের অব্যবহৃত ডাটা মোবাইল অপারেটর কেটে নিয়ে যায়। আবার সেটা অন্য গ্রাহক কিংবা একই গ্রাহকের কাছে বিক্রি করছে যা রীতিমতো চরম প্রতারণা বলে তিনি মনে করেন। স্কুলশিক্ষক হাসিনা আক্তার বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে একসময় অনলাইনে ক্লাস নিতে হয়েছে। একই সঙ্গে মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড সংযোগ রাখতে হয়েছে। তারপরও কাক্সিক্ষত মানের সেবা ও গতি পাওয়া যায়নি। খরচও হয়েছে অনেক বেশি। তার মতে, পাঁচ বছরের ব্যবধানে ইন্টারনেট গতি ও মানের বেলায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। অথচ উচ্চ গতি ও উন্নত সেবার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় সার্বক্ষণিক। এটা গ্রাহকদের সঙ্গে রীতিমতো প্রতারণা বলে তিনি মনে করেন। মোবাইল অপারেটরগুলো প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করে তাদের বিভিন্ন প্যাকেজ, সেবার বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোম্পানিগুলো ওই টাকা বিজ্ঞাপনের পরিবর্তে যদি নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেটের গতি ও সেবার মান উন্নয়নে খরচ করত তাতে বরং গ্রাহকদের উপকার হতো। কেননা নেটওয়ার্কের বেহাল দশা, কলড্রপসহ হয়রানির কোনো অন্ত নেই গ্রাহকদের। মোবাইল অপারেটরগুলো তাদের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ও প্রচারণায় দেশব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগের দাবি করলেও মাঝে মাঝে ঢাকার ভিতরেই সংযোগ পেতে ঝামেলায় পড়েন গ্রাহকরা।
ডিজিটাল জীবনযাত্রার সূচকেও পিছিয়ে : বিশ্বের অন্যতম প্রধান সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান সার্ফশার্ক ডিজিটাল জীবনমানের বিশ্বসূচক প্রকাশ করেছে গত সেপ্টেম্বরে। সে সূচক অনুযায়ী- ১১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৩তম। এশিয়ার ৩২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৩০তম এবং সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। ডিজিটাল জীবনমানে সার্বিকভাবে গত বছরের চেয়ে স্কোরও কমেছে বাংলাদেশের। গত বছর শূন্য দশমিক ৩৫ স্কোর ছিল, এ বছর তা হয়েছে শূন্য দশমিক ৩৪।
দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্নে বাংলাদেশ : ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মোবাইল ইন্টারনেটে নিম্নগতির পাশাপাশি নেটওয়ার্ক রেডিনেসে ১১০তম, ই-অবকাঠামোয় ৮৯তম এবং ই-গভর্ন্যান্সে ৮৬তম, ই-নিরাপত্তায় ১০৩তম, ইন্টারনেট ব্যবহারে আর্থিক সক্ষমতায় ৮৪তম বাংলাদেশ। এর আগে আরেক বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ওকলার প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে অবস্থান ছিল ১৭৬ দেশের মধ্যে ১৩৭তম। ওপেন সিগন্যালের রিপোর্ট অনুযায়ী ফোরজির গতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সর্বনিম্ন। এদিকে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি বাড়ানোর বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরগুলোর যে পরিমাণ গ্রাহক রয়েছে, সে হিসেবে তাদের স্পেকট্রাম বা বেতার তরঙ্গ ব্যবহারের পরিমাণ কম। ফলে সেবার মান বাড়ে না বলে তিনি মনে করেন। এদিকে বাংলাদেশের মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন এমটব-এর তথ্যমতে, প্রায় বছর ধরে চলা করোনাভাইরাস মহামারীতে মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার অনেক বেড়ে যাওয়ায় সেবার মানে প্রভাব পড়েছে। তবে বিটিআরসি তাদের চাহিদা অনুযায়ী স্পেকট্রাম বরাদ্দ দিলে সেবার মান বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করে সংগঠনটি।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি, আংকিত সুরেখা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে তরঙ্গের মূল্য পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তরঙ্গের সঠিক বণ্টন ও অপারেটরদের অ্যাকটিভ শেয়ারিংয়ের অনুমতি দেওয়া হলে গ্রাহকদের আরও উন্নত সেবা দেওয়া সম্ভব।