অনিয়মে ভেঙে গেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন।

আগে থেকেই ঋণ জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল দেশের ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। আর এসব প্রতিষ্ঠানে সুশাসনের ঘাটতিও ছিল মারাত্মক। এর সঙ্গে গত প্রায় দুই বছরে করোনার কারণে খেলাপি ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। এমন পরিস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা প্রায় ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে নিরীক্ষা করেছে তাতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিসাবের গোজামিল, অবৈধ লেনদেন, অনুমোদন ছাড়া শেয়ারবাজারে অর্থ বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কয়েক জন পরিচালক নিয়ম ভেঙে কোম্পানির অর্থ নিজের পকেটে ভরেছেন। উত্তরা ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের লেজার ব্যালেন্সে ৩ হাজার ৮০২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা রয়েছে। অথচ ব্যাংকটির বার্ষিক হিসাব বিবরণীতে ১ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা লিজ অর্থায়ন বা ঋণের তথ্য আছে। আবার ১ হাজার ৮৭৭ কোটি ২১ লাখ টাকার মেয়াদি আমানত দেখানো হয়েছে আর্থিক বিবরণীতে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ২ হাজার ৬০৩ কোটি ২০ লাখ টাকার মেয়াদি আমানতের তথ্য পেয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের এমডি ও কয়েক জন পরিচালক প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির আমানত এবং ঋণের তথ্য আড়াল করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে গোপনে অর্থ দেওয়া হয়েছে। এমনকি ভুয়া শিরোনামে প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য পেয়েছে।

এদিকে ঋণের আবেদন গ্রহণ না করেই এবং কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই অস্তিত্বহীন ২০ প্রতিষ্ঠানের নামে ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আবার ঐ কোম্পানির সাবেক এমডি রাসেল শাহরিয়ারের এক স্বাক্ষরেই ৭০০ কোটি টাকা বের হয়ে যায়। আর এসব করার জন্য সহযোগিতা করেছে রিলায়ান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি (বর্তমানে বিদেশে পলাতক) প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার।

এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদক অনুসন্ধান করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পি কে হালদারের বিরুদ্ধে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। তার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীসহ অনেকেই জড়িত থাকার বিষয়টিও সামনে এসেছে। ঘুষ নিয়ে হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য চাপা দেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্ব থেকে নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ধরনের আরও অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। এজন্য এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’ কমিটি গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দেয় আদালত। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়েছে, যারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে সে বিষয়ে কাজ করছে।

দেশে বর্তমানে ৩৫টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এদের মধ্যে কয়েকটি বাদে বেশির ভাগের অবস্থাই খারাপ। করোনা মহামারির মধ্যে পাঁচটি ছাড়া বাকিগুলো দারুণ সংকটে আছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খারাপের মাত্রা এমন পর্যায়ে যে তারা গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। খারাপ প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম উদাহরণ হলো পিপলস লিজিং। এ প্রতিষ্ঠানটিকে অবসায়নের (বন্ধের প্রক্রিয়া) জন্য অবসায়ক নিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়াও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বিআইএফসিতে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছেন আদালত।

অত্যন্ত নাজুক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ তদারকিতে রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষ করে মন্দ ঋণ এই খাতের পরিস্থিতিকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে, এটি গত এক দশকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দুই বছরে গড়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ ও ব্যবসা কমেছে। আর বিতরণ করা ঋণ আদায় হয়নি। আবার চাহিদা না থাকায় ঋণ বিতরণও খুব বেশি হয়নি। এ সময়ে দৈনন্দিন ও মাসিক খরচ ঠিকই চালিয়ে যেতে হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সংকটে পড়েছে।

এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া উদ্যোগের বিষয়েও ঐ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ধার করতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার করেছে। অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। একই সঙ্গে নীতিকাঠামোতে দেওয়া হয়েছে ব্যাপক ছাড়, যাতে দুর্বলতা কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো আবার উঠে দাঁড়াতে পারে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, আর্থিক খাতে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবল করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেসব অনিয়ম হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট তহবিলের ৮৪ শতাংশই আসে ব্যাংক থেকে। বাকি ১৬ শতাংশ সঞ্চয়ীদের আমানত ও অন্যান্য উত্স থেকে আসে। লিজিং কোম্পানিগুলো ব্যাংক থেকে স্থায়ী আমানত, মেয়াদি আমানত ও কলমানির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করত। গত দুই বছর ধরে বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে নেওয়া আমানত ও কলমানিতে নেওয়া ধার সময়মতো পরিশোধ করতে পারছিল না। পরে বাধ্য হয়ে দফায় দফায় এগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তার পরও তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ২০১৯ সালে মোট ঋণ ও লিজ ছিল ৬৭ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। গত বছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ২০ কোটি টাকায়। অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকায়। আমানত ৪৫ হাজার ১৯০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। শেয়ারহোল্ডার ইকুইটি ১১ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা থেকে কমে ৯ হাজার ৯০ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে বিনিয়োগ ও মূলধন কমেছে। কিন্তু দেনা বেড়েছে। ফলে আর্থিক ব্যবস্থাপনা আরও দুর্বল হয়েছে।

তথ্যমতে, ২০১৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫০ কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত প্রাথমিক হিসাবে খেলাপি ঋণ ১১ হাজার কোটি টাকা ছড়িয়ে গেছে। আলোচ্য সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪০ শতাংশ।

ইত্তেফাক/এসআই

LEAVE A REPLY