সম্প্রতি দেশে ওয়ান টাইম (একবার ব্যবহারযোগ্য) প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এরমধ্যে রয়েছে বোতল, গ্লাস, কাপ, প্লেট, বক্স ও চামচ। এসব ব্যবহার শেষে এসব পণ্য ফেলে দেওয়া হচ্ছে যেখানে-সেখানে। এতে একদিকে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, অন্যদিকে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত দুই দশকে শুধু রাজধানীতেই প্লাস্টিক বর্জ্য বেড়েছে ৩ গুণের বেশি।
স্বাস্থ্যবিদ ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, অবিলম্বে এসব পণ্যের ব্যবহার বন্ধ না করলে এগুলো পরিবেশ মানবস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে, এমন সতর্কতার পরও এসব পণ্য কেন বন্ধ হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন স্বাস্থ্যবিদ, পরিবেশবাদীরা। তারা বলছেন, আগে এসব পণ্য বাজারজাত করাসহ ব্যবহারের পেছনে কী কারণ রয়েছে, তা আগে উদঘাটন করতে হবে।
এদিকে, ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্রেতারা ওয়ান টাইম পাত্র ছাড়া খাবার খাচ্ছেন না। অতিরিক্ত খরচ হলেও এসব পাত্রে খাবার নিতে চান ক্রেতারা। তাই বাধ্য হয়ে দোকানিরাও ‘স্বাস্থ্যহানিকর’ এসব পণ্যে খাবার পরিবেশন করছেন।
স্বাস্থ্যবিদদের মতে, প্লাস্টিকের পাত্রে কিছু গরম করা ও সেই পাত্রে গরম খাবার খাওয়া ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। প্লাস্টিকের পাত্রে থাকা রাসায়নিক পদার্থ খাবারের মধ্যে চলে যায়। এটি খাবার থেকে শরীরে প্রবেশ করে। প্লাস্টিকপাত্রে খাবার গরম করলে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান নির্গত হয়ে খাবারে প্রবেশ করে। এটি ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ক্যান্সার, অ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যা, গর্ভপাতসহ নানা রোগ-বালাইয়ের। শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকি নয়-একইসঙ্গে বায়ুদূষণ করছে। প্রাকৃতিক পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করছে। প্লাস্টিক দ্রব্য অপচনশীল। অনেক মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী, সেসব প্লাস্টিক দ্রব্য ভক্ষণ করে। অনেক ক্ষেত্রে প্লাস্টিক সামগ্রী হজম করতে না পেরে সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে। বিশ্বে প্রতি মিনিটে অন্তত ৫ লাখ প্লাস্টিক বোতল বিক্রি হয়। বোতলটির প্রয়োজনীয়তা শেষ হওয়ার পরও তা ফেলে না দিয়ে অনবরত ব্যবহৃত হয়।
বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশনের (ইএসডিও) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ ৮৬ হাজার ৭০৭ টন। শহর এলাকায় ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, পলি ইথায়লিন ও পলি প্রপাইলিন বা এর কোনো যৌগের মিশ্রণে তৈরি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করা মূলত নিষেধ। এটি ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (৬)’-এর ‘ক’ ধারার লঙ্ঘন। এসব পণ্য বিক্রির জন্য বিক্রেতা ও ব্যবহারকারীর বিভিন্ন দণ্ড নির্ধারণ করা আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণ ও যুবকরাই বেশি ব্যবহার করছে মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ওয়ান টাইম প্লাস্টিক কাপ-প্লেট। এছাড়া, সাধারণ মানুষও প্লাস্টিকের কাপে চা পান করছে। এসব পণ্য অপচনশীল। তাই ব্যবহারের পর ফেলে দিলেও সেগুলো যুগের পর যুগ অক্ষত থেকে যায়। যা পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষণা বলছে, প্লাস্টিকের কাপে থাকা টক্সিক পদার্থ মুখ ও লিভারের ক্যানসারের প্রধান কারণ। এই ক্ষতিকর পদার্থ গরম পানির সঙ্গে সহজেই মিশে যায়। নারী-পুরুষের হরমোন কার্যকারিতায় বাধা দেয় এই ক্ষতিকর পদার্থ। এ ছাড়া হার্ট, স্তন ক্যানসার, মস্তিষ্ক ও ত্বকের ক্ষতি বয়ে আনে। মানবদেহে ক্যানসার হওয়ার বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হলো প্লাস্টিক দূষণ।
রাজধানীর বর্জ্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায় রাজধানীতে ২০০৫ সালে প্রতিদিন গড়ে ১৭৮ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হতো। সেখানে ২০২০ সালের হিসাব দাঁড়িয়েছে ৬৪৬ টনে। জলাশয় ছাড়াও হাটবাজার, বাসাবাড়ি, দোকানপাট সব জায়গায় বাড়ছে পলিথিনের ব্যবহার। গত ১৫ বছরে ৩ গুণের বেশি বেড়েছে পলিথিনের ব্যবহার।
মাটির নিচে প্লাস্টিক ৫০০ বছরেও পচে না। তাই প্লাস্টিকের কারণে ধ্বংস হচ্ছে মাটি ও পানির জৈবগুণ। খাবারের সঙ্গে প্লাস্টিকের অতিক্ষুদ্র কণা মানুষের দেহে ঢুকে ক্যান্সার ও অন্যান্য জটিল রোগ তৈরির কারণ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি ইতালির বিজ্ঞানীরা গর্ভস্থ শিশুর গর্ভফুলে প্লাস্টিক কণা পেয়েছেন। প্লাস্টিক বর্জ্যের ওপর ২৪টি গবেষণা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ বছরের মার্চে সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, প্লাস্টিকের অতিক্ষুদ্র কণা মাছসহ নানা প্রাণীর দেহে প্রবেশ করছে। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। এগুলো ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ তৈরিতে ভূমিকা রাখছে।
এ গবেষণায় অংশ নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী বলেন, ‘ওপেন সোর্স টেকনোলজি ব্যবহার করে দেখেছি, ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাচ্ছি আমরা। পানি ভর্তি বোতলের প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে প্রতি তিন দিনে প্রায় ৩ লাখ ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়। প্লাস্টিক বোতল নদীতে ফেলে দেখা গেছে তিন মাসে একটা বোতল ৩ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। এখানে তো আমরা একটা বোতল ট্র্যাক করেছি। অথচ সাগর, নদী, জলাশয়ে হাজার হাজার প্লাস্টিক বোতল ফেলা হচ্ছে। এভাবে প্লাস্টিক বোতল ছড়াতে থাকলে ধারণা করতে পারি, ২০৫০ সালে জলাশয়ে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বোতল বেশি থাকবে।’
পলিথিন ও ওয়ান টাইম প্লাস্টিক আইনিভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও এর ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না কেন তা জানতে চাইলে নগরবিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্য একটি নীরব ঘাতক। এই পণ্যটি শত শত বছর পড়ে থাকলেও পচবে না। মাটির সঙ্গে মিশেও যাবে না। আর নগরজীবনে পলিথিনের সবচেয়ে ক্ষতিকারক দিক হলো, যত্রতত্র পলিথিন ফেলে রাখলে তা পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটায়। আমরা দেখেছি, পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের কারণে ঢাকায় অল্প বৃষ্টিতে কিভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।’
ইকবাল হাবিব আরও বলেন, পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার রোধে সরকারের আগ্রহের ঘাটতি আছে। সরকারের উদাসীনতায় পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্য বাজারে দেদার চলছে।’
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. সারওয়ার জাহান বলেন, ‘আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় পলিথিন ও ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বন্ধ হচ্ছে না। পলিথিন ও ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্যের দাম কম হওয়ায় এসবের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। সবাইকে এসব পণ্য ব্যবহার না করার জন্য সচেতন হতে হবে।’
এদিকে, ২০২০ সালের ০৬ জানুয়ারি উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্টে একবার ব্যবহারযোগ্য (ওয়ান টাইম) প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার এক বছরের মধ্যে নিষিদ্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের হাই কোর্ট বেঞ্চ। একইসঙ্গে পলিথিন ও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে বাজার তদারকির পাশাপাশি পলিথিন উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতি জব্দ ও কারখানা বন্ধের নির্দেশও দেওয়া হয়। পাশাপাশি, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সারাদেশে একবার ব্যবহারযোগ্য (ওয়ান টাইম) প্লাস্টিক পণ্যের বিপরীতে নিরাপদ বিকল্প কী হতে পারে, সে বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তাও জানতে চেয়েছেন আদালত।
আদালতে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি’ (বেলা)-এর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও সাঈদ আহমদ কবির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ।
এই বিষয়ে ইত্তেফাক অনলাইনকে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘পলিথিন ব্যাগ ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যের দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বেড়ে চলেছে। এগুলো আমাদের ভূমির উর্বরতা কমাচ্ছে, বায়ু দূষণ ঘটাচ্ছে। সমুদ্রের জলজ উদ্ভিদ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে হুমকির মধ্যে ফেলেছে। তাই প্লাস্টিক সামগ্রীর উৎপাদন, বিক্রি, বিপণন, বিতরণ বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে বেলাসহ ১১টি সংস্থা ২০১৯ সালে ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট করে। রিটে এক বছরের মধ্যে এসব পণ্য ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু ওই নির্দেশনার পর প্রায় দুই বছর পার হতে চললো, তবু এসব ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। উল্টো ব্যবহার বেড়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে আগামী মাসে (অক্টোবর) আদালতে যাবো।’
পলিথিন ব্যাগ ও ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বন্ধ না হওয়ার নেপথ্য কারণ কী জানতে চাইলে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘দেশে পলিথিন ব্যাগ ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যে বন্ধ না হওয়ার জন্য সরকারের সদিচ্ছা অভাব দায়ী। কারণ এই বিষয়টি নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আন্তরিক নয়। এই বিষয়ে সরকার জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল নয়। তাই পলিথিন ব্যাগ ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য বন্ধ হচ্ছে না।’
মানবদেহে ও পরিবেশের ওপর একবার ব্যবহার্য (ওয়ান টাইম) প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে সরকার এর ব্যবহার বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বলে ইত্তেফাক অনলাইনকে জানান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। এ সময় তিনি বলেন, ‘সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ওয়ানটাইম ইউজ প্লাস্টিক মুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।’
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী বলেন, ‘পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে হাইকোর্টের একটা নির্দেশনা আছে। আমরা তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিচ্ছি। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে সোনালি ব্যাগ জনপ্রিয়তা পায়নি। পাট থেকে তৈরি পলিব্যাগও এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।’ এজন্য সরকার বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারছে না বলেও তিনি জানান।
ইত্তেফাক/এনই/এমএএম