পেশা বদলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা

মো. আলাউদ্দিন সিকদার আগে রাজমিস্ত্রির কাজ করলেও করোনায় কাজ হারিয়েছিলেন। এখন তিনি রাস্তার পাশে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র বিক্রি করেন।

করোনা মহামারির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে গেলেও এখন তা আবার সবকিছু ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তবে আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি এখনো। চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী সব শ্রেণি-পেশার মানুষই করোনায় কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। করোনা ভাইরাসের অভিঘাতে বেকারত্ব, গ্রামে ফিরে যাওয়া, আর্থিক সংকট, খাদ্যের অভাব, সমাজে অস্থিরতাসহ অনেক সমস্যা বেড়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতি হওয়ায় পেশা বদলে হলেও আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে মানুষ।

বেসরকারি একটি ব্যাংকে চাকরি করতেন রনি ইসলাম (ছদ্মনাম)। করোনার শুরুতে চাকরি হারান তিনি। জমানো টাকায় কিছুদিন চলেন। এরপর বিভিন্ন অনলাইনে প্রশিক্ষণ কোর্সে শিক্ষকতা করেন। সেটাও বন্ধ হয়ে যায় একসময়। এখন অনলাইনে স্ত্রীকে নিয়ে পোশাক বিক্রির চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিক্রি খুব কম। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার ধানমন্ডির বাসা ছেড়ে পরিবারকে নিয়ে বাসা নিয়েছেন কেরানীগঞ্জে। সেখানেও কতদিন টিকতে পারবেন জানেন না।

এদিকে ২০১৭ সালে ‘চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠ’ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছিলেন মো. নান্নু। সেই কণ্ঠশিল্পী করোনার কারণে জীবিকার তাগিদে এখন রেললাইনে সবজি বিক্রি করেন। খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর আঞ্জুমান রোডের আমতলা মোড় এলাকার বাসিন্দা মো. নান্নু আগে বিভিন্ন স্টেজ শোতে গান গাইতেন। করোনার কারণে সব অনুষ্ঠান বন্ধ। তাই ৩২ বছর বয়সি এই কণ্ঠশিল্পী সবজি বিক্রি করে এখন সংসার চালান।

করোনায় সবচেয়ে বেশি চাকরিচ্যুত হয়েছেন বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক এবং অন্যান্য কর্মচারী। গৃহকর্মী, দিনমজুর, ব্যাংককর্মী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সবাই কোনো না কোনোভাবে করোনাকালে অর্থনৈতিক ধাক্কায় টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এতে অনেকেই বাঁচার তাগিদে নিজেদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি যে কেমন রূপ নেবে তা এখনো গবেষকরা ধারণা করতে পারছেন না।

স্বাস্থ্যবিধি শিথিল করে দেওয়ায় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়েছে। খুলছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল। আপাতদৃষ্টিতে সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। কিন্তু করোনার অভিঘাতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কমে এসেছে। ব্যবসা কমে আসায় কর্মী ছাঁটাই, বেতন কমাতে বাধ্য হয়েছে মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। মানুষের আয় কমে যাওয়ায় ব্যয় করার ক্ষেত্রও কমেছে। ফলে, দারিদ্র্য বাড়ছে। ব্যবসা না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানকে কর্মী ছাঁটাই করায় বেড়েছে বেকারত্ব। এ পরিস্থিতিতে বিচিত্র পেশায় যুক্ত হচ্ছে মানুষ। স্কুলশিক্ষক বনে গেছেন সবজি বিক্রেতায়। কলেজের ছাত্র রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছেন থালা বাসন বাটি। দেখা যাচ্ছে, দেশের লাখ লাখ মানুষ নিজের পুরোনো পেশায় ফিরতে পারছেন না। তারা নতুন নতুন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন পরিবারের সদস্যদের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দিতে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন ইদ্রিস হোসেন। এখন তিনি জাফরাবাদে মুদির দোকান চালান। বাসের হেলপার খোরশেদ এখন রিকশা চালায়। জাভেদ আলমগীর ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। চাকরি হারিয়ে এখন নওগাঁর গ্রামে গিয়ে মাছ চাষ করছেন আর নিজের জমি চাষাবাদ করে পরিবারের ভরণপোষণ চালানোর চেষ্টা করছেন। জাভেদ আলমগীর বলেন, গত বছর লকডাউনের মাঝামাঝি চাকরি চলে যায়। জমানো টাকায় কিছুদিন চলেছি। ঘরভাড়া, সন্তানদের পড়াশোনা এসব সঞ্চয়ের টাকা ভেঙে চালিয়েছি। শেষ পর্যন্ত উপায় না দেখে গয়নাগাটি বিক্রি করেছেন। করোনার কারণে চাকরি গেলে নতুন চাকরি পাওয়া কঠিন। তাই, শেষমেশ বাড়িতেই ফিরে এসেছি।

বেঁচে থাকার জন্য হাজার হাজার মানুষ পেশা বদল করেছেন। শুধু সংসারের দুমুঠো ভাতের জোগান দিতে আদালতের আইনজীবী হয়ে গেছেন ইউটিউবার, করপোরেট হাউজের কর্মকর্তা হয়ে গেছেন অনলাইনে পণ্য বিক্রেতা, ফুটপাতের দোকানদার হয়েছেন বাসের হেলপার কিংবা রিকশাচালক। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা কাজ করছে চায়ের স্টলে, রেস্টুরেন্টে। রাজধানী ঢাকায় এমন হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ পেশা বদল করে জীবনের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন।

সরকারি গবেষণা-প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে দেশে নতুন করে ১ কোটি ৬৩ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। দেশে এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা-প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনায় দারিদ্র্য ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়াও গত জুন মাসে পিপিআরসি ও বিআইজিডির যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, দারিদ্র্য দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে। এছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে দেখা গেছে, করোনায় মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে যাদের আয় ছিল প্রতিদিন ১০০ টাকা। করোনার কারণে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকায়।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গত অর্থবছরে পুঁজি গঠনের হার কমে গেছে। পুঁজি গঠন কম হলে কর্মসংস্থান কম হয়। এর ফলে পিছিয়ে পড়া মানুষের কর্মহীনতা বাড়ে। মানুষের ভোগের জন্য খরচ বৃদ্ধির হারও কমে গেছে। আয় ও ভোগ কম হলে দারিদ্র্য বাড়বে। এর ফলে বৈষম্যও বাড়বে। বৈষম্য বৃদ্ধির আরেকটি লক্ষণ হলো, আমাদের মজুরি বৃদ্ধির হার কমেছে। বহু দিন পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মজুরি সূচকে আমরা পতন দেখছি। এর ফলে কর্মসংস্থান ও আয় উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যা হচ্ছে।

অন্যদিকে প্রথাগত দরিদ্র যারা ছিল অর্থাত্ অনানুষ্ঠানিক খাত, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের কর্মীদের সঙ্গে মাঝারি খাতের লোকজনও ঢুকে যাচ্ছে। এর মানে পিছিয়ে থাকাদের সঙ্গে ‘পেছনে ঠেলে দেওয়া’ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এটি একটি বড় দুশ্চিন্তার বিষয়।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে সমাজে অনেক পরিবর্তন আসবে। লাখ লাখ কর্মজীবী মানুষ নতুনভাবে জীবন শুরু করবেন। বর্তমানে নিম্ন আয়ের বেতনভুক্ত কর্মচারী তারা বর্তমানে চরম অর্থনৈতিক ও মানসিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন কর্মীদের নিয়মিত বেতন দিতে পারছে না। চাকরিচ্যুত মানুষরা বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নতুন নতুন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এদের বেশির ভাগই পুরোনো পেশায় ফিরতে পারবেন না।

ইত্তেফাক/বিএএফ

LEAVE A REPLY