বার্সেলোনায় ম্যারাডোনা
১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টিনার কোচ সিজার মেনেত্তি ১৯৮৩ এর মার্চে বার্সেলোনার কোচের দায়িত্ব নিলেন। ডিয়াগো ম্যারাডোনা তখন বার্সার সবচেয়ে আলোচিত তরুণ ফুটবলার। পূর্ববর্তী কোচ লাতেক-এর সাথে ম্যারাডোনার বনিবনা হচ্ছিল না বিভিন্ন কারণে। বিশেষ করে লাতেকের ট্রেনিং পদ্ধতি অপছন্দের ছিল ম্যারাডোনার।
মেনেত্তি যোগ দেবার পর ক্লাবের সমর্থকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কারণ মেনেত্তির প্রতি ম্যারাডোনা প্রকাশ্যে শ্রদ্ধা দেখাতেন এবং তাকে নিজের পিতার সাথে তুলনা করতেন। ম্যারাডোনা এটাও বলতেন, তিনি মেনেত্তির হারিয়ে যাওয়া সন্তান। মেনেত্তিও প্রেসকে আশ্বস্ত করলেন স্বদেশী ম্যারাডোনার কাছ থেকে কিভাবে সেরাটা বের করে আনতে হবে সেটা তার জানা আছে। বার্সেলোনার সেই সময়ে শিরোপা খরা যাচ্ছিল। ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপে অস্ট্রিয়ার ছোট ক্লাব মেমফিসের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছে।
এর আগে ১৯৮২-এর জানুয়ারিতে হেরেছে সুপার কাপের ফিরতি ম্যাচে ইংল্যাণ্ডের অ্যাস্টন ভিলার কাছে ৩-১ গোলে। ততদিনে মেনেত্তির নয়া ফুটবল দর্শনের উপর লেখা ‘ফুটবল উইথাউট ট্রিক্স’ বইটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ক্লাবে যোগ দিয়েই মেনেত্তি প্র্যাকটিস সেশনের সময়সূচি সকালের বদলে দুপুর তিনটায় নির্ধারণ করলেন। বলা বাহুল্য তা করলেন মূলত ম্যারাডোনাকে খুশি রাখার জন্যই।
এই দুই আর্জেন্টাইনের আরেকটা বিষয়ে মিল ছিল। বার্সেলোনার রাতের পার্টি লাইফ চুটিয়ে উপভোগ করতে পছন্দ করতেন দুজনেই। মেনেত্তি আরেকটা মনস্তাত্ত্বিক কাজ করলেন। বার্সার আরেক নামী ফুটবলার সুস্টারের সাথে ম্যারাডোনার দোস্তালি মজবুত করালেন। এর ফলাফল এলো হাতে হাতে।
১৯৮৩ সালের কিংস কাপে (কোপা ডেল রে) ম্যারাডোনা-সুস্টারের সুপার কম্বিনেশনে বার্সেলোনা হারালো ২-১ গোলে হারালো রিয়াল মাদ্রিদকে। বার্সেলোনার মেয়র প্যাসকেল মারাগেল এই জয় উপলক্ষ্যে বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করে রাজনৈতিক বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই বিজয়ে জনগণের আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়েছে’।
মেনেত্তির ফুটবল দর্শনের কড়া সমালোচক ছিলেন অ্যাথলেটিকো বিলবাওএর কোচ হাভিয়ার ক্লেমেন্ত। যিনি পরে স্পেনের জাতীয় দলের দায়িত্ব নেন। এই দুই কোচের মৌখিক লড়াই এতোটাই উত্তপ্ত ছিল যা খেলোয়াড়দের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতো। ম্যারাডোনা ছিলেন এক্ষেত্রে বেশি ঠোঁটকাটা। সুতরাং স্প্যানিশ মিডিয়ার টার্গেটে পরিণত হলেন তিনি।
মেনেত্তি একবার ক্লেমেন্তের ফুটবল কৌশলকে বুলফাইটের সাথে তুলনা করলে ক্লেমেন্ত পাল্টা জবাব দিয়ে বললেন, মেনেত্তি মেয়েদের শরীর যত ভালো বোঝেন ফুটবল ততটা ভালো বোঝেন না। ওদিকে ম্যারাডোনা মিডিয়ায় পাল্টা অভিযোগ করতে থাকলেন স্প্যানিশ মিডিয়া ইচ্ছা করে কঠিন ট্যাকল আর ফাউলগুলো টিভি পর্দায় ভালো করে দেখায় না, বরং ফাউলের দৃশ্যগুলো ‘অফ স্ক্রিন’ করে রাখে।
কারণ স্পেনের গড়পরতা অন্যান্য দলগুলোও ক্লেমন্তের ভাব ধারায় ফুটবল খেলতো। তার প্রতি করা ফাউলগুলো ক্যামেরা ও দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর জন্য ম্যারাডোনা নিজস্ব টেকনিক অবলম্বন করা শুরু করলেন। পেছন থেকে কেউ ট্যাকেল করলেই ম্যারাডোনা দুই হাত শূণ্যে ভাসিয়ে বুকের উপর আছড়ে পড়তে থাকলেন। এমন ভয়াবহ দৃশ্য দেখে দর্শক, রেফারি ও মিডিয়া সবাই নড়ে চড়ে উঠলো।
কিন্তু এই কৌশলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না ম্যারাডোনা। অবশেষে ১৯৮৩র ২৪ সেপ্টেম্বর বার্সেলোনা ক্যারিয়ারের বড় দুর্ঘটনাটা ঘটলো ক্লেমন্তের ক্লাব বিলবাওর সাথে লিগ ম্যাচে। ন্যু ক্যাম্পে খেলতে এসে কোচ ক্লেমেন্ত যেন চরম প্রতিশোধ নিলেন। লা লিগার গুরুত্বপূর্ণ সেই ম্যাচে ২৪ সেপ্টেম্বর ন্যু ক্যাম্পে বিলবাও মুখোমুখি হয়েছিল বার্সেলোনা। বিলবাও তখন লিগ চ্যাম্পিয়ন।
প্রথমার্ধে বার্সেলোনা ২-০ গোলে এগিয়ে গেল। দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিপক্ষের গোল মুখে বল নিয়ে ড্রিবল করে ঢোকার সময় বিলবাওর পাঁচ নম্বর জার্সিধারী স্প্যানিশ ডিফেণ্ডার গোয়কোচিয়া পেছন থেকে যে ফাউলটি করেছিলেন এখন পর্যন্ত স্প্যানিশ ফুটবল ইতিহাসের সেটি সবচেয়ে নির্মম ও বাজে ফাউল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বাম পায়ের গোড়ালী ভেঙে তিন মাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে গেলেন ডিয়াগো ম্যারাডোনা। পরবর্তীতে ম্যারাডোনা বর্ণনা করে বলেছিলেন, ‘কাঠ ফাটার শব্দে তার বাম পা ভেংগে গিয়েছিল’।
ইংলিশ স্পোর্টস জার্নালিস্ট এডওয়ার্ড ওয়েন সেই মুহূর্তে মাঠে উপস্থিত ছিলেন। তিনি গোয়কোচিয়াকে উপাধি দিলেন ‘বিলবাওর কসাই’ নামে। মেনেত্তি দাবি করলেন, গোয়কোচিয়াকে সারা জীবনের জন্য ফুটবলে নিষিদ্ধ করতে। তবে স্প্যানিশ ফুটবল লিগ মাত্র দশ ম্যাচের জন্য গোয়কোচিয়াকে সাসপেণ্ড করেছিল। ম্যারাডোনা হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না।
তিন মাস পর ইনজুরি থেকে ফিরেই আবার মুখোমুখি হলেন অ্যাথলেটিকো বিলবাওর বিপক্ষে সান মেমস স্টেডিয়ামে। পুরো ম্যাচে মোট পঞ্চাশটা ফাউল হয়েছিল। সতীর্থদের নিয়ে ম্যারাডোনা খেললেন জীবনবাজী রেখে এবং জিতলেন ২-১ গোলে। বিলবাওকে হারিয়ে তিন মাস আগের ইচ্ছাকৃত আঘাতের প্রতিশোধ নিলেন। কামব্যাক স্টোরি হিসেবে ম্যারাডোনার এই ম্যাচ ফুটবল ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে।
পরবরতীতে জার্মানির সাথে এক ম্যাচে গোয়কোচিয়া কঠিন ফাউল করেছিলেন সুস্টারকে। তখন আবার সাত ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন গোয়কোচিয়া। কিন্তু সেই আঘাত কাটিয়ে সুস্টার পরবর্তীতে স্বাভাবিক খেলা উপহার দিতে পারেন নি। ক্যারিয়ার সংক্ষিপ্ত করতে বাধ্য হলেন। তবে ফুটবল ইতিহাসে একজন নির্মম ডিফেণ্ডার হিসেবে গোয়কোচিয়ার নাম চিরস্থায়ী হয়ে থাকল।
নেপলসে ম্যারাডোনা
নেপলসের জীবন যাপনের অনেক কিছুই কিংবদন্তি আর্জেন্টাইন ম্যারাডোনা তার আত্মজীবনী ‘এল দিয়াগো’তে সযত্নে এড়িয়ে গেছেন।
বিশেষ করে ইতালির মাফিয়া পরিবারের সাথে তার সখ্যতার দিনগুলো। কেবল
নেপোলিতে গড়া কীর্তিগুলো উল্লেখ করেছেন বইটিতে। কিন্তু নেপোলির মাফিয়া
পরিবার গুলিয়োনো চক্রের সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং তাদের মাধ্যমে কোকেন আসক্তি,
অবাধ স্বেচ্ছাচারী জীবনের অধ্যায়গুলো দিয়াগো পরবর্তীতে স্বীকার করলেও
বইটিতে অস্পষ্ট ছিল।
ম্যারাডোনার নেপোলি-অধ্যায় নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র ‘দিয়াগো ম্যারাডোনা নির্মিত হয়েছিল ২০১৯ সালে। ছবিটি মুক্তি দেয়া হয়েছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে। পরিচালক আসিফ কাপাডিয়া এই অসাধারণ কাজটি করেছেন মূলত ম্যারাডোনা-ভক্তদের জন্য। অকপটে তুলে ধরেছেন দিয়াগোর নেপোলি জয় এবং নব্বই বিশ্বকাপের পর ‘হিরো থেকে জিরো হওয়ার নির্মোহ গল্পটা।
১৯৮৪ সালে ব্যক্তিগত টানাপড়েনে বার্সেলোনা ছেড়ে ম্যারাডোনা নেপোলিতে চলে আসলেন। মূল কারণ বার্সেলোনাতে প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছিলেন না। সেই সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন কোপা দেল রে কাপের ফাইনালে অ্যাথলেটিকো বিলবাওর ম্যাচে মারামারির ঘটনায়। নানা কারণে বার্সেলোনা ক্লাব কর্তৃপক্ষ বিরক্ত ছিল ম্যারাডোনার প্রতি।
বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টাইন কোচ সিজার লুই মেনেত্তি অনেক আশা করে ম্যারাডোনাকে বার্সেলোনায় নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু দিয়াগোতে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল কঠিন। মূলত ‘৮৪ সালে কোপা দেল রে কাপের ফাইনাল ম্যাচে অ্যাথলেটিকো বিলবাও দলের খেলোয়াড়দের সাথে খণ্ডযুদ্ধে জড়িয়ে ম্যারাডোনা স্পেনে ব্যাপক সমালোচিত হন।
খেলা শেষ হবার সময় ম্যারাডোনা লাথি আর ঘুষি দিয়ে আহত করেন বিলবাওর তিন জন খেলোয়াড়কে। নিজেও আহত হন। এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে পুরো স্টেডিয়ামে। মোট ষাট জন দর্শক মারামারিতে আহত হন। মাঠের লড়াইয়ের মূল কারণ ছিল বিলবাও ডিফেণ্ডার গোয়কোচিয়া কয়েক মাস আগে কড়া ট্যাকল করে দিয়াগোর গোড়ালি ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। এতে তার ক্যারিয়ার ধ্বংস হতে পারতো।
কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে দিয়াগো আবার সুস্থ হয়ে মাঠে ফেরেন, এবং বিলবাওয়ের সাথে ফিরতি ম্যাচে গোল দিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। কোপা দেল রের সেই ম্যাচে ম্যারাডোনাকে আবারো যথেচ্ছ ফাউল করা হচ্ছিল এবং রেফারি নির্বিকার ছিল। এছাড়াও অভিযোগ উঠে স্টেডিয়ামে দর্শকদের সারিতে উপস্থিত ম্যারাডোনার পিতাকে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হতে হয়েছিল।
আদিবাসী লাতিন আমেরিকান হবার কারণে বিলবাও সমর্থকদের হাতে নাজেহাল হন দিয়াগো চিতোরো। ম্যারাডোনা সেদিন ভেতরের ক্ষোভ আটকে রাখতে পারেন নি। খেলার মাঠে চূড়ান্ত স্ক্যাণ্ডালের জন্ম দিলেন। সেই ঘটনার পর এই ক্ষ্যাপাটে প্রতিভাকে আর দলে রাখতে চাইলো না বার্সেলোনা। তখনই সুযোগটা নিয়ে নিলো ইতালির নেপোলি।
ইতালির ক্লাবে যোগ দেবার বছরে ম্যারাডোনা যখন রেলিগেশনের শংকার থাকা নেপোলির হয়ে লিগের শীর্ষে থাকা জুভেন্টাসের বিপক্ষে ফ্রি-কিকে গোল করলেন, পুরো নেপলস শহর তখন পাগল হয়ে গিয়েছিল। পাঁচ জন নেপোলি সমর্থক অজ্ঞান হয়ে যান এবং দুইজন হার্ট অ্যাটাক করেন। এমন এক ফুটবল-সর্বস্ব পরিবেশে ম্যারাডোনার নেপোলি পর্ব শুরু হয়েছিল।
পরবর্তীতে নেপলসবাসী তাকে তুলনা করতে শুরু করলেন ঈশ্বরপ্রেরিত দূত হিসেবে। শহরে নির্মিত হলো দিয়াগোর মূর্তি। নেপোলিতে তখন ম্যারাডোনা মানেই সব কিছু। অথচ শুরুতে নেপোলির সাথে চুক্তিতে ম্যারাডোনা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন বিশাল বিলাস বহুল বাড়ী, কিন্তু পেয়েছিলেন ফ্ল্যাট। চেয়েছিলেন ফেরারী গাড়ী, পেয়েছিলেন ফিয়াট মডেলের সাধারণ কিছু।
পরবর্তীতে সাফল্যের কারণে অবশ্য পরিস্থিতি আমূল বদলে যায়। বিলাসবহুল জীবনের সব কিছু আয়ত্ত্ব করেছিলেন দিয়াগো। নেপোলির মতো মাঝারি সারির দলকে ইতালি ও ইউরোপ সেরা করার কৃতিত্বে ম্যারাডোনা কাল্ট ফিগারে রূপান্তরিত হয়ে পড়েছিলেন। তবে নেপোলিতে ক্যারিয়ারের শেষের সময়টা ছিল অসম্মান ও অপমানের, নানা কারণে ও অকারণে।
বিশেষ করে ইতালি মিডিয়া রীতিমত উঠে পড়ে লেগেছিল তার ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে। কারণ, ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা টাইব্রেকারে ইতালির বিপক্ষে গোল করলেন। ইতালি বাদ পড়লো বিশ্বকাপ থেকে। এর আগে ম্যারাডোনা নেপলসবাসীদের আহবান জানিয়েছিলেন যেন তারা নিজের দেশের বদলে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করে!
এরপর পুরো ইতালি তার শত্রু বনে গেল। অবশেষে নেপোলিকে নিজের শেষটুকু নিংড়ে দিয়ে পরপর দুই বছর লিগ চ্যাম্পিয়ন ও উয়েফা কাপ জিতিয়ে ‘৯০ বিশ্বকাপের পর ক্লাব ত্যাগ করলেন ম্যারাডোনা। হয়ে গেলেন সম্পূর্ণ একাকী। সেই সাথে কোকেন ও নারী কেলেংকারির অভিযোগে ইতালিতে নিষিদ্ধ হলেন।
অথচ ১৯৮৪ সালে যেদিন দিয়াগো ক্লাবে যোগ দিলেন সেদিন তাকে এক নজর দেখতে উপস্থিত হয়েছিলেন পঁচাশি হাজার দর্শক।
এ যেন রোমান ট্র্যাজডি! ২০২০ সালে দিয়াগোর আকস্মিক মৃত্যুর পর নেপোলি তাদের
স্টেডিয়ামের নাম বদলে দেয়। স্টেডিয়ামটির নতুন নাম দেয়া হয় ‘দিয়াগো
আরমান্ডো ম্যারাডোনা স্টেডিয়াম। নেপলসে অবশেষে চিরস্থায়ী হলেন ম্যারাডোনা!