ব্যাংককর্মীদের পুনর্বহালে গড়িমসি

করোনাকালে ছাঁটাই ও পদত্যাগে বাধ্য করা ব্যাংককর্মীদের চাকরিতে পুনর্বহালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় দুই মাস আগে নির্দেশনা দেওয়া হলেও সেটি কার্যকরে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে ভুক্তভোগীদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে না। এতে হতাশ হয়ে পড়ছেন ভুক্তভোগীরা। কারণ দুই মাস ধরে চাকরি পুনর্বহালের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তাঁরা। চাকরি ফেরতের দাবিতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যানের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দপ্তরেও চিঠি পাঠিয়েছেন তাঁরা। 

kalerkantho

গত বছরের মার্চে দেশে করোনার আঘাত আসে। এরপর সংক্রমণ বাড়তে থাকায় টানা ৬৬ দিনের ছুটির কবলে ছিল দেশ। এ সময়ে প্রায় সব কিছু বন্ধ থাকলেও জরুরি সেবার আওতায় ব্যাংকগুলো খোলা রাখা হয়। ব্যাংকাররা সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অফিস করেন। পরবর্তী সময়ে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রোধে কয়েক দফার লকডাউনের মধ্যেও ব্যাংকিং সেবা বন্ধ রাখা হয়নি। এর পরও খরচ কমানোর অজুহাতে ব্যাংক খাতেও কর্মীদের অমানবিকভাবে চাকরিচ্যুত, ছাঁটাই ও পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেও কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রমাণ মেলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সার্কুলারে ছাঁটাই করা কর্মীদের দ্রুত পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয়।

নির্দেশনায় বলা হয়, প্রমাণিত কোনো অভিযোগ ছাড়া এখন থেকে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। করোনাভাইরাসের এই সময়ে শুধু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ বা অদক্ষতার কারণ দেখিয়েও কাউকে ছাঁটাই করা যাবে না। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার পরও করোনার এই সময়ে যাঁদের চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, আবেদন সাপেক্ষে তাঁদের পুনর্বহাল করতে হবে। এরপর ভুক্তভোগীরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আবেদন করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংক এই বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

চাকরিচ্যুত বেশ কয়েকজন কালের কণ্ঠকে জানান, করোনাকালে খরচ কমানোর অজুহাতে তাঁদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। চাকরি হারিয়ে তাঁরা অনেকটাই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এরপর চাকরিতে পুনর্বহাল নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় আশার আলো দেখতে পান তাঁরা। কিন্তু সেই আশার আলোতেও এখন চিড় ধরছে। কারণ চাকরিতে পুনর্বহালের কোনো আশ্বাসই তাঁরা পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একদিকে কর্মীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে। এর মানে লোকবলের দরকার নেই এমনটি নয়। তাই যৌক্তিক কারণ ছাড়া কাউকে ছাঁটাই বা পদত্যাগে বাধ্য করা হয়ে থাকলে অবশ্যই তাঁদের চাকরি ফেরত দেওয়া উচিত। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের দেখা উচিত। কোনো ব্যাংক এটি পরিপালন না করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়াসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মনে হয় খরচ কমানোর জন্য ব্যাংকগুলো এ ধরনের পদক্ষপ নিয়েছে। তবে কর্মী ছাঁটাই কোনো সমাধান নয়। ব্যাংকগুলো যেহেতু সমস্যার মধ্যে আছে, তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ছাঁটাই কর্মীদের পুনর্বহালের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে কয়েকটি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত ব্যাংককর্মীরা তাঁদের পুনর্বহালের অনুরোধ করে চিঠি পাঠান। এর মধ্যে একটি ব্যাংকের শতাধিক কর্মী লিখেছেন, ‘বর্তমানে প্রায় সবাই চাকরিজীবনের মাঝামাঝি কিংবা শেষ প্রান্তে। প্রত্যেকের সন্তানরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। অনেকের গৃহনির্মাণসহ অন্যান্য ঋণের কিস্তি চলমান রয়েছে, যা বেতন-ভাতা থেকে নির্বাহ করা হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, করোনার এই সময়ে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অন্যায় ও অমানবিকভাবে ব্যাংকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ এবং শাখাপ্রধানসহ মধ্যম ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের টার্মিনেট করা, সার্ভিস বেনিফিটসহ আর্থিক সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত করাসহ নানাবিধ হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সব খাতে নিয়োগ স্থবির থাকায় আমাদের জীবন-জীবিকা অত্যন্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়ে আমরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মহামারির সময় চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগ করা কর্মীদের পুনর্বহালের বিষয়ে যে সার্কুলার দেওয়া হয়েছে, তা বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করেই দেওয়া। এখন যদি কোনো ব্যাংক এ নির্দেশনা না মানে, তাহলে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেসরকারি খাতের ছয়টি ব্যাংকে কর্মী ছাঁটাই নিয়ে বিশেষ পরিদর্শন করে। এতে উঠে আসে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই ব্যাংকগুলোর মোট তিন হাজার ৩১৩ জন কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে বয়স থাকার পরও ‘স্বেচ্ছায় পদত্যাগ’ দেখানো হয়েছে তিন হাজার ৭০ জনকে। এ ছাড়া ২০১ জনকে অপসারণ, ৩০ জন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত ও ১২ জন কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দেখানো বেশির ভাগই কর্মকর্তা-কর্মচারী জানিয়েছেন, স্বেচ্ছায় পদত্যাগের জন্য মৌখিকভাবে তাঁদের একটি সময় দেওয়া হয়েছিল। ওই তারিখের মধ্যে পদত্যাগ না করলে কোনো সুবিধা দেওয়া হবে না—এমন ভয় দেখানো হয়। এমন প্রেক্ষাপটে বাধ্য হয়ে তাঁরা পদত্যাগ করেন।

LEAVE A REPLY