সাইবার হয়রানির শিকার ৮৮ শতাংশ নারী মামলা করেন না

তথ্যপ্রযুক্তি এ যুগে মানুষের জীবনকে যতটা সহজ করে দিয়েছে, ঠিক তেমনি নানা রকম হয়রানির হুমকিও তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে নারীরা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন বেশি। ফলে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের সেবা দেয়ার লক্ষ্যে গত বছর প্রতিষ্ঠা করা হয় পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার ৬৪১ জন নারী ভুক্তভোগী সাইবার স্পেসে হয়রানিসংক্রান্ত বিষয়ে যোগাযোগ করেছেন এই সেলে। কিন্তু অভিযোগকারীদের বেশির ভাগই মামলা বা জিডি করতে চান না। শুধুমাত্র হয়রানি করা ফেক আইডি কিংবা কন্টেন্ট ডিলিটের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে চান। এতে সাইবার অপরাধীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পারিবারিক বা সামাজিক কারণে ভিকটিম নারীদের ফেক আইডি বা কন্টেন্ট ডিলিটের মাধ্যমে আপসে খুশি না হয়ে আইনগতভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তাহলে সাইবার অপরাধীরা বেপরোয়া হতে পারবে না। এতে করে নারীদের সাইবার হয়রানির সংখ্যাও অনেক কমে আসবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন প্রতিষ্ঠার পর ১৭ হাজার ২৮০ জন সেবাপ্রত্যাশী যোগাযোগ করেছেন। এর মধ্যে হয়রানিসংক্রান্ত ১২ হাজার ৬৪১ অভিযোগের মধ্যে আট হাজার ২২১ জনকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা দেয়া হয়েছে। অভিযোগ দেয়া ১২ হাজার ৬৪১ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ জিডি বা মামলা করেছেন। অর্থাৎ ৮৮ শতাংশ ভুক্তভোগী মামলা করেন না। যে ১২ শতাংশ ভুক্তভোগী মামলা করেন তাদের মধ্যে আবার ৮৭ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্তের পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত কার্যক্রম এগিয়ে নেন না।

জানা গেছে, পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখার অধীনে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের সেবা কার্যক্রমটি পরিচালিত হয় নারী অফিসারদের দ্বারা। এলআইসি শাখা সূত্র জানায়, সাইবার অপরাধ করা হয় বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে মাধ্যমে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অভিযুক্ত আইডির বিষয়ে সব সময়ে তথ্য পাওয়া যায় না, যা সাইবার অপরাধ তদন্তে অন্যতম বাধা। এ বিষয়ে সম্প্রতি ফেসবুকের বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ, বিটিআরসি, বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার ও এজেন্সির সঙ্গে পুলিশের বৈঠক হয়েছে। ফেসবুকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যে ইস্যু বা অভিযোগ তুলে আইডির তথ্য চাওয়া হয়, সেটি সংশ্লিষ্টের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে পড়ে না। তাই তারা অনেক আইডির তথ্য দিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি থাকলে তখন তারা তথ্য সরবরাহ করতে অনেকটা বাধ্য থাকেন। তাই চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশসহ উভয়ে ইতিবাচক রয়েছে। যে কোনো সময় এ চুক্তি হতে পারে।

এলআইসি শাখার তথ্য অনুযায়ী, ভুয়া আইডি ব্যবহারে মাধ্যমে হয়রানি করার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি, যা মোট অভিযোগের ৪৩ শতাংশ বা পাঁচ হাজার ৪৭৫ জন। এ সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে ১ হাজার ৮৮৪ জন নারীকে, আর আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানির করা হয় ৯৯২ জনকে। অন্যান্য উপায়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৫১৮ জন। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে বিভিন্ন বয়সি নারী ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। তবে অভিযোগকারীর শতকরা ১৬ ভাগ ভুক্তভোগী ১৮ বছরের কম বয়সি। শতকরা ৫৮ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। ২৫-৩০ এর মধ্যে ভুক্তভোগী ২০ ভাগ এবং ৬ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৪০ বছরের বেশি। ঢাকা বিভাগ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক ভুক্তভোগী এই সেলে অভিযোগ করেছেন, যা মোট অভিযোগের ৬৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ১৭ শতাংশ; খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগ থেকে ৪ শতাংশ; বরিশাল থেকে ৩ শতাংশ ও ময়মনসিংহ থেকে ২ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন।

এলআইসি শাখা জানিয়েছে, নারীদের জন্য চালু করা এ সেলে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক অভিযোগ আসছে। বর্তমানে থাকা লোকবল দিয়ে ভুক্তভোগীদের সেবা দেয়া অনেকটা কষ্টসাধ্য। আরো দক্ষ জনবল প্রয়োজন। দিন দিন সাইবার অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। তাদের মোকাবিলা করতে হলে দক্ষ জনবলের বিকল্প নেই। এছাড়া ভুক্তভোগী অভিযোগকারীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই নারীদের নিয়ে কাজ করা এই সেলের পরিধিও বাড়ানো উচিত। এলআইসি শাখাও মনে করে, এই সেলটি একসময় পুলিশের একটি ইউনিট হিসেবে রূপ পাবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (এলআইসি) মীর আবু তৌহিদ বলেন, প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক অভিযোগ আসছে। সেলে নারী-শিশু ও বয়স্ক ডেস্ক রয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যোগাযোগ করা ভুক্তভোগীকে সেবা দিয়ে থাকেন। সেবা দিতে গিয়ে থানা পুলিশসহ বিভিন্ন ইউনিটের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়। ভুক্তভোগীদের মধ্যে যারা আইনি ব্যবস্থা নিতে চান না। আইডি উদ্ধার করে দিলে বা কন্টেন্ট ডিলিট করলেই তারা খুশি। তবে তাদের মানসিক শক্তি জোগানো হয়। মোট অভিযোগের মধ্য থেকে ৩৫২ জন অভিযুক্তকে শনাক্ত করা হয়েছে, যারা দেশের বাইরে অবস্থান করে অপরাধ কার্যক্রম করেছে। আমরা এমন অভিযোগ পাওয়ার পর অভিযুক্তদের আইডি বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করেছি।

সাইবার স্পেসে নারীরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। সাইবার বুলিং, ট্রলিং, মানহানি, পরিচিত তথ্য ব্যবহার ও প্রকাশ, ব্ল্যাকমেইলিং, রিভেঞ্জ পর্নোসহ বিভিন্ন উপায়ে নারীদের সাইবার স্পেসে হয়রানি করা হয়। তাই পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে, ফোনে (০১৩২০০০০৮৮৮) এবং ই-মেইল অ্যাড্রেসে যোগাযোগকারী নারী ভুক্তভোগীদের সেবা দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করা হয়। দ্রুত সেবা ও সমাধান পাওয়ার কারণে দিন দিন ফেসবুক পেজটি জনপ্রিয় হচ্ছে।

প্রথম বর্ষপূর্তি পালিত হবে আজ: পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের প্রথম বর্ষপূর্তি পালিত হবে আজ মঙ্গলবার। পুলিশ সদর দপ্তরের মূল ভবনের হল অব ইন্টেগ্রিটি কক্ষে কেক কেটে বর্ষপূর্তি উদযাপন করা হবে। বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। ডি-এফবি

LEAVE A REPLY