ফাইল ছবি
মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তরণের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। পরিষদের ৭৬তম বৈঠকের ৪০তম প্লেনারি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের মধ্য দিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে এখন চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটল বাংলাদেশের। এলডিসি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর প্রস্তুতির সময় পাওয়া যাবে।
সাধারণত প্রস্তুতির জন্য তিন বছর সময় দেয়া হলেও মহামারি করোনার কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এই বাড়তি সময় দেয়া হলো। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এটিকে ‘ঐতিহাসিক অর্জন’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, এই অর্জন বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার এক মহান মাইলফলক। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে হচ্ছে বাংলাদেশকে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এর মধ্যে প্রস্তুতিও শুরু করেছে সরকার।
জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল ও লাওসের ক্ষেত্রেও একই সুপারিশ করা হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় দ্বিতীয়বারের মতো এলডিসি থেকে উত্তরণের মানদণ্ড পূরণের সুপারিশ লাভ করে বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশ তুলনামূলক দুর্বল; সেসব দেশকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যে দেশ জাতিসংঘ নির্ধারিত তিনটি মানদণ্ড পূরণের মাধ্যমে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের এ অর্জন বিশ্ব দরবারে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে এবং আরো অধিকতর উন্নয়নের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে। প্রস্তুতিকালে বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে যেসব সুযোগ-সুবিধা এতদিন পেয়ে আসছিল, সেগুলো অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরো ৩ বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে। জাতিসংঘের ৪০তম প্লেনারি সভাটি গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বুধবার গভীর রাতে এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
তবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সুপারিশটি গ্রহণ করা হলেও চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে বাংলাদেশকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে ওই বছরের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের স্বীকৃতি লাভ করবে। এতদিন বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রক্রিয়া, সব সূচকে মান অর্জন, সুপারিশ- এসবই ছিল জাতিসংঘের কারিগরি কমিটির কার্যক্রম। এখন বাংলাদেশের উত্তরণের বিষয়টি রাজনৈতিক অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি : এলডিসি উত্তরণে পণ্য রপ্তানিসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত থেকে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। প্রস্তুতিকালীন সময়ের মধ্যে চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করা হবে। এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও বিশেষ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে ১৩টি ক্ষেত্রে সুপারিশমালা দিয়ে এলডিসি উত্তরণে ‘অ্যাকশন প্লান’ তৈরি করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ। কোনো মন্ত্রণালয়, সংস্থা বা অধিদপ্তর সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে সেটিও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে বার্ষিক চাঁদা বেশি দিতে হবে বাংলাদেশকে। এ ছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ইস্যুতে ওষুধশিল্পে নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে। বেড়ে যাবে ওষুধের দাম এবং এতে রপ্তানি বাজারও কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহজশর্তের ঋণ ও অনুদান সহায়তা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। রপ্তানি পণ্য ও শিল্পে ভর্তুকি দেয়ার সুবিধা হ্রাস করতে হবে। তবে বেশকিছু কিছু কৌশল নেয়া গেলে সহজেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে দেশের সামনে। তবে দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাক রপ্তানিতে জিএসপি প্লাস এবং স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি পাওয়া যেতে পারে। তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে শ্রম অধিকার, কারখানার কর্মপরিবেশ ও মানবাধিকার ইস্যুতে ২৭টি শর্ত পরিপালনের শর্ত দিয়েছে ইইউ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব শর্ত পালনে বেশকিছু কৌশল নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, এলডিসি উত্তরণের ‘পলিসি মেট্রিক্স ফর কপিং আপ উইথ এলডিসি গ্রাজুয়েশন’ নামে একটি সুপারিশমালা দিয়েছে জিইডি। এর মধ্যে রাজস্ব নীতি, মুদ্রানীতি, শিল্প ও বাণিজ্য নীতি, অবকাঠামো খাত উন্নয়ন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মতো কর্মসূচি রয়েছে। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম জানান, এলডিসি উত্তরণের পর বেশকিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জ আসবে। কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হলেও সুযোগও তৈরি হবে অনেক। সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, এ লক্ষ্যেই পলিসি মেট্রিক্স ফর কপিং আপ উইথ এলডিসি গ্রাজুয়েশন শীর্ষক একটি সুপারিশমালা তৈরি করা হয়েছে।
বহির্বিশ্বে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে : এলডিসি উত্তরণের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে হলেও ঋণ নিয়ে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে অধিক খরচ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিগুলোর দেয়া রেটিং বাড়বে, যা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে। এই অর্জন বড় ভূমিকা রাখবে দেশের ব্র্যান্ডিংয়ে। এ প্রসঙ্গে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়াবে। দেশের ভাবমূর্তি ব্র্যান্ডিংয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এটি দেশের জন্য বড় অর্জন- মন্তব্য করে তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রবাসে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন তাদের জন্যও এ অর্জন সহায়ক হবে। এ ছাড়া সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই পেতে যে ক্রেডিট রেটিংয়ের প্রয়োজন সেক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এটা বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। যে কোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেক উপাদান থাকে। ব্যবসার পরিবেশকে উপযুক্ত করার জন্য সরকারের অনেক নীতি থাকে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হলে এসব নীতি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণে অনেক সমস্যা তৈরি হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এগুলো সমাধানে ভূমিকা নিতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে অগ্রাধিকার বাণিজ্যসহ মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
বিভিন্ন দেশের অগ্রাধিকার ও মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হবে : এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম গতিশীল ও রপ্তানি বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করার প্রস্তুতিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে ১১টি দেশের সঙ্গে এ সংক্রান্ত সম্ভাব্যতা ও সমীক্ষা যাচাই করা হয়। ভুটানের পর এবার নেপালের সঙ্গে পিটিএ করা হবে। এরপর ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সঙ্গে পিটিএ করা হবে। শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত করতে পিটিএ, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এফটিএ এবং বৃহৎ অংশীদারত্ব বাণিজ্য চুক্তির (সিপা) মতো বড় বড় চুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে রপ্তানিতে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিশ্চিত করতে চায় বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) জুয়েনা আজিজ বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি পর্যালোচনা করছেন।
এ লক্ষ্যে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সঙ্গে দরকষাকষি করা হচ্ছে। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরও যাতে অন্তত. ১২ বছর স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্যে সুযোগ-সুবিধা বহাল রাখা হয় সেজন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইউ) এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তর ইউএসটিআরে আবেদন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। এসআর