ওমিক্রন ধরনের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাকে শাস্তি দেওয়ার অভিযোগ

করোনাভাইরাসের উদ্বেগজনক নতুন ধরন ওমিক্রন আবিষ্কার করার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাধুবাদ দেওয়ার পরিবর্তে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন দেশটির কর্মকর্তারা। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ অভিযোগ করেছে।

মূলত করোনার এই ধরনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশের পরপরই বিভিন্ন দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তার ভিত্তিতে ওই বিবৃতি দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা।

প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণে দেখা গেছে, ওমিক্রনে পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি রয়েছে। অর্থাৎ একবার এই ধরনে কেউ আক্রান্ত হলে তার পুনর্বার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) শুক্রবার বলেছে, নতুন ধরনটি ‘উদ্বেগজনক’।

ইউরোপে এখন বেশ কয়েকজনের মধ্যে এই ধরন শনাক্ত করা হয়েছে- যুক্তরাজ্যে দুইজন, জার্মানিতে দুইজন, বেলজিয়ামে একজন এবং আরেকজন ইতালিতে আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া চেক প্রজাতন্ত্রে একজন এই ধরনে আক্রান্ত বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

ইসরায়েলেও নতুন এই ধরনে আক্রান্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। এর পরই তারা রবিবার মধ্যরাত থেকে ভিনদেশিদের ইসরায়েলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়।

এই নিষেধাজ্ঞা ১৪ দিন ধরে চলবে বলে জানিয়েছে সেখানকার গণমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল।

বতসোয়ানা ও হংকংয়েও ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে নেদারল্যান্ডসে আসা শত শত যাত্রীকে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে যে তাদের মধ্যে কেউ নতুন ধরন দ্বারা আক্রান্ত কি না। দুটি কেএলএম ফ্লাইটের প্রায় ৬১ জন যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফলে কভিড-১৯ পজিটিভ এসেছে।

তাদেরকে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আমস্টারডামের শিফোল বিমানবন্দরের কাছে একটি হোটেলে কোয়ারেন্টিন করে রাখা হয়েছে, ডাচ্‌ কর্মকর্তা সূত্রে এ খবর জানা যায়।

নেদারল্যান্ডস বর্তমানে রেকর্ড পরিমাণ করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। রবিবার সন্ধ্যা থেকে দেশটিতে আংশিক লকডাউনের সময়সীমা বাড়ানো হয়।

গত ২৪ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের বিষয়টি প্রথমবারের মতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানায়।

‘বিজ্ঞান চমৎকারিত্ব’
শনিবার দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, “বিজ্ঞানের চমৎকারিত্বকে প্রশংসা করা উচিত এবং শাস্তি দেওয়া উচিত নয়।’

নিষেধাজ্ঞাগুলো ‘নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটি দ্রুত শনাক্ত করতে উন্নত জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের সক্ষমতা থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।’

বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, যখন বিশ্বের অন্য কোনো দেশ নতুন ভ্যারিয়েন্ট আবিষ্কার করেছিল, তখন প্রতিক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আফ্রিকান ইউনিয়নের একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টির জন্য উন্নত দেশগুলো দায়ী।

“এখন যা হচ্ছে এমনটা হওয়ারই ছিল, বিশ্ব একটি ন্যায়সংগত, জরুরি এবং দ্রুত উপায়ে টিকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আজ এমন পরিস্থিতি হয়েছে। এটি উচ্চ আয়ের দেশগুলোর টিকা মজুদ করার ফলাফল, এবং বেশ সত্যি বলতে বিষয়টা মেনে নেওয়া যায় না।” বলেছেন আফ্রিকার ইউনিয়নের ভ্যাকসিন ডেলিভারি অ্যালায়েন্সের কো-চেয়ার আয়োআদে আলাকিজা।

‘এই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাগুলো রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে হয়, বিজ্ঞানের ভিত্তিতে নয়। এটা ভুল হচ্ছে… যেখানে এই ভাইরাসটি এরই মধ্যে তিনটি মহাদেশে ছড়িয়েছে, সেখানে আমরা কেন আফ্রিকাকে বন্ধ করে দিচ্ছি?’

শুক্রবার এবং শনিবার, বেশ কয়েকটি দেশ নতুন ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে :

দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, মালাউই, জাম্বিয়া, লেসোথো এবং এসওয়াতিনি থেকে কোনো ভ্রমণকারী যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না যদি না তারা ইউকে বা আইরিশ নাগরিক বা যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা হন।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, লেসোথো, এসওয়াতিনি, মোজাম্বিক এবং মালাউই থেকে বিদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে দেওয়া হবে না, এর আগে ইইউ এমন পদক্ষেপ নিয়েছিল। সোমবার থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের কথা রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া শনিবার ঘোষণা করেছে যে দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, লেসোথো, এসওয়াতিনি, সেশেলস, মালাউই এবং মোজাম্বিক থেকে ১৪ দিনের জন্য ফ্লাইট স্থগিত করা হবে। অস্ট্রেলীয় নন এমন যারা গত দুই সপ্তাহে ওইসব দেশে ছিলেন, তাদের এখন অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশে নিষেধ করা হয়েছে।

জাপান ঘোষণা করেছে, শনিবার থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা বেশির ভাগ ভ্রমণকারীকে ১০ দিনের জন্য কোয়ারেন্টিন করতে হবে এবং সেই সময়ে মোট চারটি পরীক্ষা করতে হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা এবং হংকং থেকে আগত ভ্রমণকারীদের জন্য ভারত আরো কঠোর স্ক্রিনিং এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার আদেশ দিয়েছে।
গত ১৪ দিনে দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, লেসোথো, এসওয়াতিনি বা মোজাম্বিকে ভ্রমণ করেছেন এমন বিদেশি নাগরিকদের কানাডায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে যে প্রাথমিকভাবে বি.১.১.৫২৯ নামে পরিচিত, এই ভ্যারিয়েন্টটিতে আক্রান্তের সংখ্যা, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় সব প্রদেশে বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এই ভ্যারিয়েন্টটির প্রচুর মিউটেশন হচ্ছে, যার মধ্যে কয়েকটি বেশ উদ্বেগজনক।’

এতে বলা হয়েছে, ‘প্রাথমিকভাবে বি.১.১.৫২৯ নামে পরিচিত এই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণের বিষয়টি গত ৯ নভেম্বর সংগৃহীত একটি নমুনা পরীক্ষায় প্রথম নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।’

ডাব্লিউএইচও বলেছে যে নতুন ভ্যারিয়েন্টটির প্রভাব কতটা তীব্র, সেটা বুঝতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে, কারণ বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করছেন যে এটি কতটা সংক্রামক।

যুক্তরাজ্যের এক শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেছেন, নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে প্রচলিত ভ্যাকসিনগুলো ‘অবশ্যই’ কম কার্যকর হবে।

কিন্তু অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল বায়োলজিস্ট প্রফেসর জেমস নাইসমিথ বলেছেন: “এটা খারাপ খবর কিন্তু এটাই শেষ নয়।”

দক্ষিণ আফ্রিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান বিবিসিকে বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় এখন পর্যন্ত আক্রান্তের যেসব খবর পাওয়া গেছে, সেখানে কভিড পরিস্থিতি এতটা গুরুতর ছিল না। সেখানকার মাত্র ২৪% জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে -তবে তিনি বলেছেন, ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপারে তদন্ত এখনো খুব প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

‘রোগীরা বেশির ভাগই শরীর ব্যথা, ক্লান্তি, চরম ক্লান্তিতে ভোগার কথা বলেছেন এবং এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন অল্প বয়সীরা, কোনো বয়স্ক মানুষ নয়… আমরা এমন রোগীদের কথা বলছি না, যারা সরাসরি হাসপাতালে যেতে পারে এবং ভর্তি হতে পারে’। অ্যাঞ্জেলিক কোয়েতজি বলেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক ব্যাধির প্রধান অ্যান্থনি ফাউচি বলেছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিষয়ে প্রতিবেদনগুলো যখন লাল সতর্কবার্তা দিচ্ছে, তখন এটিও সম্ভব যে ভ্যাকসিনগুলো এখনো গুরুতর অসুস্থতা প্রতিরোধে কাজ করতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, দ্রুত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা দেশগুলোর বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলেছে যে তাদের একটি ‘ঝুঁকিভিত্তিক এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির’ দিকে নজর দেওয়া উচিত।
সূত্র : বিবিসি বাংলা।

LEAVE A REPLY