সাংগঠনিক ভিত গড়তে পারছে না জাতীয় পার্টি

পঁয়ত্রিশ বছর আগে জনতা দল, কাজী জাফর আহমেদের ইউপিপি, গণতান্ত্রিক পার্টি ও মুসলিম লীগের একাংশের সমন্বয়ে গঠিত ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ বিলুপ্ত করে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি ‘জাতীয় পার্টি’ গঠন করেন সে সময়ের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পার্টির প্রথম চেয়ারম্যান হন তিনি। একসময়ে প্রতাপের সঙ্গে দেশ চালানো জাতীয় পার্টি বলতে গেলে দিনে দিনে ক্ষয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই সংগঠনের ভিত মজবুত করতে পারছেন না দলটির নেতারা।

জাতীয় পার্টির দপ্তর সূত্র দাবি করছে, মোট ৭৬টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কিমিটি রয়েছে ৪২টি জেলায়। ৩৪ জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। তবে বিভিন্ন জেলা নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়, জেলাগুলোতে কমিটি থাকলেও তা একেবারেই কাগজে-কলমে। দলীয় ও জাতীয় কর্মসূচিও পালন হয় না এমন সাংগঠনিক জেলার সংখ্যা প্রায় ৭২টি। ওই সব জেলায় দিনে দিনে নেতারা আরো বেশি রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছেন। অনুসন্ধানে ১০ জেলা পাওয়া গেছে, যেখানে আহ্বায়ক কমিটিও নেই। আবার এমন জেলাও রয়েছে ওই জেলায় ১৯৯০ সালে এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে কোনো কমিটি হয়নি।

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদের জীবিতকালেই পাচঁবার ভেঙেছে পার্টি। ১৯৯১ সালে প্রথম জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে আলাদা জাতীয় পার্টি করেন এরশাদ জমানার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মতিন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে ‘জেপি’ নামে দল করেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিএনপি জোটে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন নাজিউর রহমান মঞ্জু। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টি থেকে বের হয়ে পৃথক জাতীয় পার্টি গঠন করেন কাজী জাফর আহমেদ ও মোস্তফা জামাল হায়দার। এর আগে ২০০১ সালে কাজী জাফর আহমেদ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন দল থেকে বিরয়ে যান, কিছুদিন পর কাজী জাফর ফিরলেও শাহ মোয়াজ্জেম ফেরেননি।

জাতীয় পার্টির সংগঠন কেন মজবুত হচ্ছে না? এ বিষয়ে পার্টির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে- জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দল হলেও জনপ্রত্যাশা অনুসারে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ জাপাকে ক্ষমতাসীনদের অনুগত একটি অংশই মনে করছে।

দ্বিতীয়ত, জাপার অগ্রগতির পেছনে একটি বড় বাধা এরশাদের রেখে যাওয়া সম্পদ ও পারিবারিক কলহ। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের পুরনো বিরোধের সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছেন বিদিশা সিদ্দিক। বিদিশা সিদ্দিক নিজেই এখন জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এরশাদের আত্মীয়দের একাংশ রয়েছেন জি এম কাদেরের সঙ্গে, বড় অংশটি বিদিশা ও রওশন কেন্দ্রিক। বিদিশাকেন্দ্রিক আত্মীয়দের লক্ষ্য এরশাদ ট্রাস্ট দখল করা। পারিবারিক প্রাধান্য থেকে বেরোতে পারছে না দলটি।

তৃতীয়ত, জাপার কর্মকাণ্ড এখন মূলত চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় ও জি এম কাদেরকেন্দ্রিক। দলে কয়েক ডজন জ্যেষ্ঠ নেতা ও ঢাউস সাইজের কেন্দ্রীয় কমিটি থাকলেও সবাই নিষ্ক্রিয়। সংসদ সদস্যরা যতটুকু কাজ করেন, সেটা বাস্তবে তাদের নির্বাচনী এলাকা ঘিরে। সংগঠন সম্প্রসারণের দিকে তাদের কোনো কর্মকাণ্ড নেই।

চতুর্থত, নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার মতো কোনো কর্মসূচি নেই দলে। নতুন প্রজন্মের কোনো কর্মী দলে টানার উদ্যোগও নেই। যৌবনকালে এরশাদের ক্ষমতার মোহে যে লোকগুলো জাপায় এসেছিলেন, এখন পর্যন্ত সেই বয়স্ক লোকেরাই জাপার মূল সম্পদ। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব নেই দলে। 

পঞ্চমত, দল পরিচালনায় রয়েছে অর্থসংকট। প্রয়াত এইচ এম এরশাদ দল পরিচালনা করার জন্য সর্বশেষ চার নেতার কাছে অর্থ গচ্ছিত রেখেছিলেন। একজনকে অর্থ দিয়েছিলেন চীনের সঙ্গে ব্যবসার জন্য, চীনের গুয়াংজুতে অফিসও নেওয়া হয়েছিল। একজনকে গুলশানে বিপণিবিতান নির্মাণ করার জন্য টাকা দিয়েছিলেন, প্রতিবেশী একটি দেশে বিপণিবিতানের জন্য অর্থ দিয়েছিলেন একজনকে, আরেক নেতার নামে কয়েক শ বিঘা জমি কেনা হয়েছিল সাভারে। এরশাদের মৃত্যুর পর নেতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে এরশাদ কারাগারে থাকতে যে সফলতা পেয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে সে অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি জাতীয় পার্টি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জাপা ৩৫টি আসনে জিতেছিল। ১৯৯৬ সালে ৩২টি আসন। ২০০১ সালে পায় ১৪টি। ২০০৮ সালে পায় ২৭টি। ২০১৪ সালে পায় ৩৪টি, বর্তমান সংসদে জাপার আসন ২২টি। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায়, দিনে দিনে দলটির অবস্থান দুর্বল হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের সময়ে অনুষ্ঠি জাতীয় সংসদের শূন্য আসনের উপনির্বাচনে একমাত্র রংপুর-৩ আসনে সাদ এরশাদ বাদে অন্য সব আসনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতিয়ে দিতে রাতের আঁধারে দেনদরবারে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন জাপা প্রার্থীরা। একই অবস্থা হয়েছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও। ঢাকা-১৪ আসনে জাপা প্রার্থী প্রত্যাহার করায় বিনা বাধায় জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী।

জাপা প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান রাতের আঁধারের যোগাযোগের কথা অস্বীকার করে বলেন, সংগঠনিক দুর্বলতা ও কর্মীর অভাবে তিনি নির্বাচন করেননি। যদিও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের অপরাধে মোস্তাকুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে জাতীয় পার্টি। তৃণমূলে সাংগঠনিক অবস্থা এতটাই দুর্বল যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে লাঙল প্রতীক নিয়ে মাত্র ১৩৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

কেন শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা যাচ্ছে না? এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু কালের কণ্ঠকে বলেন, এটা সত্য যে জাতীয় পার্টির যতটা গোছানো ও শক্তিশালী সংগঠন থাকার কথা ছিল, বাস্তবে তা নেই। এর কারণও রয়েছে। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালীন নানা ধরনের মামলা ঝুলিয়ে রেখে কার্যত তাকে এক ধরনের বন্দিদশায়ই রাখা হয়েছিল। তাকে সংগঠন গোছানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি। এরপর আমাদেরও কিছু ব্যর্থতা রয়েছে, যেভাবে পারার কথা ছিল আমরা পারিনি। তবে বলতে পারি, আগামী দিনগুলোতে এ দশা থাকবে না। আমরা দেশব্যাপী সাংগঠনিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। বিভিন্ন জেলায় বর্ধিতসভা করব, দল শক্তিশালী করাই এখন প্রধান কাজ। এটা ঠিক, নতুন প্রজন্মকে দলে টানার মতো তেমন নির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই। এ নিয়ে আমাদের গবেষণা চলছে। আমরা বেকার সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের পারিবারিক যে সমস্যার কথা সবাই বলছে এটাকে সমস্যা মনে করি না। কারণ উপমহাদেশের রাজনীতি বাস্তবে পরিবারকেন্দ্রিক, উত্তরাধিকারকেন্দ্রিক।

LEAVE A REPLY