সিরাজগঞ্জে বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা ব্যবহার করেছেন অবৈধ অস্ত্র। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সে ছবি প্রকাশের পরও আটক হননি কেউ। শুধু সিরাজগঞ্জ নয়, সারা দেশে ইউপি নির্বাচনে গোলাগুলি, সংঘাত ও মৃত্যুতে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ছিল সর্বোচ্চ। অতীতের অনেক নির্বাচন হার মানিয়েছে এমন পরিস্থিতি। এর বাইরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে জেলা সদর এমনকি উপজেলা ইউনিয়ন পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে অবৈধ অস্ত্রের ছবি মাঝেমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে অস্ত্র আর উদ্ধার হয় না। শহরভিত্তিক পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতেও অবৈধ অস্ত্রের সংগ্রহ দেখা যাচ্ছে। তাদের অনেকেই কথায় কথায় বের করছে অবৈধ অস্ত্র। এ অস্ত্রের উৎপত্তি ও কীভাবে তারা তা সংগ্রহ করছে তা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করলেও উদ্ধারের পরিমাণ আশানুরূপ নয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নির্বাচনের সময়ই যে অস্ত্রের ব্যবহার তা কিন্তু ঠিক নয়। সারা বছরই অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং এর ব্যবহারকারীরা তৎপর থাকে। অবৈধ ও বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার থামাতে সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নিয়ে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। অপরাধীরা কে কোন রাজনৈতিক দলের নেতা কিংবা কর্মী তা খুঁজতে গেলে কখনো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ৫ সেপ্টেম্বর নোয়াখালী জেলা শহরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও ধাওয়া চলাকালে চার তরুণের হাতে প্রকাশ্যে অস্ত্র দেখা গেছে। এর আগে ৩০ আগস্ট চট্টগ্রামের চন্দনাইশে শোক দিবসের কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত হয়। এর একপর্যায়ে সেখানে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছোড়েন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সদস্য গিয়াস উদ্দিন ওরফে সুজন। গুলি ছোড়ার ভিডিওচিত্র বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। চার দিন পর ৪ সেপ্টেম্বর র?্যাব রিভলবার, পিস্তলসহ গিয়াস উদ্দিনকে গ্রেফতার করে।
৬ জুন পাবনায় গণপূর্ত বিভাগের দফতরে অস্ত্র নিয়ে যান আওয়ামী লীগের একদল নেতা, যারা ঠিকাদারিও করেন। এ ঘটনার সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা একটি ভিডিও সম্প্রতি প্রকাশ হলে তা আলোচনায় আসে।এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি ক্রয়, নির্মাণকাজ ও প্রাতিষ্ঠানিক নানা কর্মকান্ডে স্বচ্ছতার জন্য প্রতিযোগিতামূলক যে টেন্ডার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, সরকারদলীয় নেতা-কর্মী ও স্বার্থান্বেষী মহলের অবৈধ বলপ্রয়োগ, হুমকি-ধমকি এবং জবরদখলে দীর্ঘদিন ধরেই তা অকার্যকর হয়ে আছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট নানা কর্তৃপক্ষ ছোটখাট কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বরাবরই তা অস্বীকার এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুরক্ষা প্রদান করে আসছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি অস্ত্রগুলো বৈধ হয়েও থাকে তবু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতরে জনসম্মুখে এভাবে অস্ত্র প্রদর্শন করে ভীতি সঞ্চার আইনসিদ্ধ হতে পারে না। তাই এ ঘটনাকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বলাটা অত্যুক্তি হবে না।’
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল কে এম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অপরাধী আমাদের কাছে অপরাধী। সে যে-ই হোক না কেন! নির্বাচন কেন্দ্র করে যারা অবৈধভাবে দখল নিতে চায় তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য র্যাব কিশোর গ্যাংয়ের ওপরও বিশেষ নজর দিয়েছে। অনেক কিশোর সংশোধন হতে আমাদের পরামর্শ নিয়েছে। আমরা তাদের সহযোগিতা করছি। তবে গ্যাং নিয়ে প্রতিটি ব্যাটালিয়নকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে হামলার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, মুখে মাস্ক পরা এক যুবক হাতের ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। ওই সময় তার বাহিনী লাঠিসোঁটা নিয়ে আশপাশের মানুষের ওপর হামলা করে। এর আগেও পাগলায় প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করার ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কয়েক বছরে গ্যাং কালচার ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক মূল্যবোধের ওপর ভয়াবহ মাত্রায় প্রভাব ফেলছে বখে যাওয়া কিশোর-কিশোরীদের আচরণ। তাদের অনেকের কাছেই রয়েছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানা তথ্য দিয়েছে। তারা জড়িয়ে পড়ছে নানাবিধ অপরাধে।
পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক হায়দার আলী খান বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র বাড়ার বিষয়টি পরিসংখ্যান ছাড়া বলা ঠিক হবে না। তবে অবৈধ কিংবা বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার এর কোনোটাই কাম্য নয়। দেশের কোনো প্রান্তে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সে অনুযায়ী তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। অস্ত্রধারী যে-ই হোক না কেন আমরা আমাদের কাজটি করেই যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রায়ই অব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই এটি সম্ভব হয়। পুলিশের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীও অবৈধ অস্ত্রসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।’
অনুসন্ধান ও বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারত ও মিয়ানমারে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ছোট ছোট কারখানায় তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা এলাকায় ভারতে অস্ত্র তৈরির কমপক্ষে ৩০টি কারখানা রয়েছে। বিশেষ করে ভারতের বিহার রাজ্যের মুঙ্গের, ঝাড়খন্ড, মিজোরাম, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, মালদহসহ বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্রের বেশ কিছু ছোট ছোট কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় অস্ত্র তৈরি করছে মুঙ্গেরে বন্ধ হয়ে যাওয়া বিভিন্ন অস্ত্র কারখানায় কাজের অভিজ্ঞতা থাকা চৌকস কারিগররা। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় কারবারিদের নিজ বাড়ি বা ভাড়া করা বাসায় লেদ মেশিন বসিয়ে তৈরি করা অস্ত্র দেশি-বিদেশি চক্রের হাত ঘুরে চলে আসছে বাংলাদেশে। মূলত ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের কমপক্ষে ২০টি পয়েন্ট দিয়ে অনেকটা অবাধে এসব অস্ত্র দেশে ঢুকছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান খন্দকার ফারজানা রহমান জানান, শুধু নির্বাচন এলেই অবৈধ অস্ত্র বিষয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়। তবে প্রকৃত সত্য হলো সারা বছরের বিভিন্ন সময় অবৈধ অস্ত্র দেশে প্রবেশ করে। রাজনৈতিকভাবে যারা দুর্বৃত্ত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত অবৈধ অস্ত্রের প্রতি তাদের আগ্রহ সব সময়ই ছিল। তাদের মদদেই চোরাকারবারিরা নানা কৌশলে অস্ত্র সরবরাহ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সাবেক আইজিপি ও কিশোরগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ বলেন, অবৈধ অস্ত্রের প্রবেশ ঠেকাতে চোরাচালানের জন্য যে রুটগুলো ব্যবহার হয় সেখানে গোপনে ও প্রকাশ্যে নজরদারি বাড়ানো জরুরি। একই সঙ্গে গণমাধ্যমসহ সচেতন মানুষের ভূমিকা রাখা দরকার। আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ওইসব এলাকায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংস্থাগুলোর সিনিয়র কর্মকর্তাদের নিবিড় তদারকি খুবই প্রয়োজন।
র্যাব সদর দফতর সূত্র বলছেন, গত বছর বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ৭৪২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ৮৪৪টি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি অস্ত্র, ১৭৯টি ম্যাগজিন, ৬ হাজার ৮৫৯ রাউন্ড গোলাবারুদ, ১২ হাজার ২৮টি বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক।
বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০১টি বিভিন্ন ধরনের অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৭টি ম্যাগজিন, ২০৪টি গোলাবারুদ, ৯১৯ কেজি বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে।