তুরস্কের তরুণ প্রজন্ম কেন দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে চাইছে?

“আমি এখানেই থাকতে চাই কারণ এটা আমার বাড়ি। কিন্তু একই সঙ্গে আমি এই দেশ ছেড়ে চলেও যেতে চাই কারণ আমি একজন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই,” বলেন রাজধানী আঙ্কারায় ২৮ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী বার্না আকদেনিজ, যিনি সাংবাদিকতার ওপর পিইচডি করছেন।

বার্না একজন বধির। শোনার জন্য তাকে তার কানের ভেতরে বসানো একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। এটিকে বলা হয় ককলেয়ার ইমপ্ল্যান্ট।তবে সাম্প্রতিক কালে বাইরের দেশ থেকে আমদানি করা এধরনের মেডিকেল সরঞ্জামাদির ঘাটতি দেখা দেওয়ায় তার মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে যে তিনি হয়তো ভবিষ্যতে আর নাও শুনতে পারেন।

“যারা এই ককলেয়ার সরবরাহ করে তারা ঘোষণা করেছে যে ২০২২ সালে জানুয়ারির পর থেকে তারা এই যন্ত্রটি আর আমদানি করতে পারবে না। লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি এবং লিরার বিনিময় মূল্য কমে যাওয়ার কারণে এই ব্যবসায় তাদের আর লাভ হচ্ছে না। ফলে তাদের ব্যবসায় সাহায্য করার জন্য তারা এখন সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলবে,” বলেন তিনি।

“কিন্তু তারা যদি কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারে তাহলে কী হবে?” বার্নার প্রশ্ন। “এর ফলে কী ধরনের পরিণতি হতে পারে সেটা ভেবেও আমি ভয় পাচ্ছি।”

দেশেই থাকবেন নাকি দেশ ছেড়ে চলে যাবেন- তুরস্কের বহু মানুষের কাছে এটা এখন এক জটিল প্রশ্ন। এধরনের লোকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে যাদের অনেকেই বয়সে তরুণ।

এর পেছনে একটা কারণ তুরস্কের বিপর্যস্ত অর্থনীতি।

বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ১৯ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ডিসেম্বর মাসে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ৩৬%-এর বেশি। পরিবহন, খাদ্যসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবারের খরচও বহুগুণে বেড়ে গেছে।

তুর্কী মুদ্রা লিরার মারাত্মক রকমের পতন ঘটেছে। এক বছরেই এর দাম কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ।

স্বল্প-আয়ের পরিবারগুলো সংসারের হিসাব মেলাতে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি হিমশিম খাচ্ছে। এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাব পড়েছে তুরস্কের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ওপরেও।

‘আমি চাই নিরাপত্তা’

বিদেশে চলে গেলে কী ধরনের সুবিধা-অসুবিধা তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে লোকজনকে আলোচনা করতে দেখা যায়। ইতোমধ্যেই যারা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন তাদের অভিজ্ঞতার কথাও শুনতে চান অনেকে।

তবে নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন নি বার্না। তবে তিনি ইউরোপে যেতে আগ্রহী।

এই পছন্দের পেছনে “সেখানে বধির লোকজনকে রাষ্ট্রীয় যে সাহায্য সহযোগিতা দেওয়া হয় সেটাই প্রধান কারণ।”

“আমি নিরাপত্তা চাই,” বলেন তিনি। “আমি যে শুনতে পারবো এবিষয়ে আমি নিশ্চয়তা চাই।”

তুরস্কে যেসব শহুরে ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত তরুণ তরুণী বিদেশে চলে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন বার্না তাদের একজন।

এর আগে বিভিন্ন সময়ে তুরস্কের পিছিয়ে থাকা গ্রামীণ এলাকা থেকে যারা ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছেন, তাদের চেয়ে বর্তমানের অভিবাসন-প্রত্যাশীদের অবস্থা ভিন্ন।

এই নতুন প্রজন্মের অভিবাসন-প্রত্যাশীদের একজন তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় গাজিয়ানটেপ শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৮ বছর বয়সী ছাত্র হারুন ইয়ামান।

টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও রেডিও মিডিয়ার ওপর পড়াশোনা করে তিনি ডিগ্রি নিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ইউরোপের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ার বিষয়ে তিনি মানসিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তার ইচ্ছা তিনি আয়ারল্যান্ডে চলে যাবেন।

হারুন ২০১৮ সালে স্নাতক পাস করেছেন। কিন্তু তিনি যেসব বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করেছেন সেসব জায়গায় এখনও তিনি কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেন নি। বর্তমানে তিনি একটি গার্মেন্টস কোম্পানিতে কাজ করছেন।

“আমি এই দেশের ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না,” বলেন তিনি, “আর একারণেই আমি চলে যেতে চাই।”

হারুন যে ‘ওয়ার্ক এন্ড স্টাডি’ বা ‘কাজ করার পাশাপাশি পড়ালেখা’ প্রোগ্রামে আয়ারল্যান্ডে যেতে চান তার জন্য আবেদন করতে কিছু অর্থের প্রয়োজন। এর কিছুটা তিনি ইতোমধ্যে সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু তুর্কী মুদ্রা লিরার বড় ধরনের দরপতনের পর তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে।

এই পরিস্থিতিতে পুরো ফি পরিশোধ করার জন্য তাকে আরো অর্থ জমাতে হবে এবং এজন্য তার আরো কিছু সময়ের প্রয়োজন।

“তুরস্কে আমার কোনো সামাজিক জীবন নেই। দিনে আমি ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় কাজ করি। মুদ্রার সঙ্কটের কারণে আমাদের ক্রয় ক্ষমতাও চলে গেছে। আমাদের এতো এতো সমস্যা। সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে মানুষ আরো বেশি দরিদ্র হয়ে গেছে এবং মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি হয়েছে,” বলেন তিনি।

অনেকেরই বিদেশ জীবনের স্বপ্ন

সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়- যারা তুরস্ক ছেড়ে চলে যেতে চান তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ২৫ থেকে ২৯।

দেশটির ২০২০ সালের অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য গত সেপ্টেম্বর মাসে পরিসংখ্যান ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে প্রকাশ করার কথা ছিল যা স্থগিত করা হয়েছে।

তারা ২০১৯ সালের সর্বশেষ যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে অন্যান্য দেশে বসবাসের জন্য তিন লাখ ৩০ হাজার মানুষ তুরস্ক ছেড়ে চলে গেছে যা তা আগের বছরের তুলনায় ২% বেশি।

ধারণা করা হচ্ছে, সর্বশেষ পরিসংখ্যানেও দেখা যাবে যে এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।

ইস্তাম্বুলের ইয়েদিতেপ বিশ্ববিদ্যালয় ও ম্যাক কনসালটেন্সি ২০২০ সালের অগাস্ট মাসে তরুণদের ওপর অভিবাসনের বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে যার ফলাফল দেশটিকে স্তম্ভিত করেছে।

জরিপে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের ৭৬% বলেছেন যে তারা ভিন্ন কোনো দেশে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, যদি তাদেরকে সাময়িকভাবে সেই সুযোগ দেওয়া হয়।

তাদেরকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় যে অন্য দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হলে তারা স্থায়ীভাবে তুরস্ক ছেড়ে চলে যেতে চায় কীনা- এই প্রশ্নের উত্তরে তাদের ৬৪% বলেছেন, এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে তারা প্রস্তুত।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অন্যান্য দেশের মতো তুরস্কের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তুর্কী মুদ্রা লিরার বিপর্যয়ের কারণে দেশটির অর্থনীতির আরো অবনতি হয়েছে।

তবে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক একজন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং তুর্কী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ইব্রাহিম সিরকেচি মনে করেন এর পেছনে তুরস্কের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে।

“অবশ্যই এটা তুরস্ক থেকে নতুন অভিবাসনের ঢেউ,” বলেন তিনি।

স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা

“সমাজের বড় একটা অংশ ভবিষ্যতের ব্যাপারে তাদের আশা হারিয়ে ফেলেছে কারণ তারা মনে করে যে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, শিল্পী এবং পণ্ডিত ব্যক্তিরাও।”

এজন্য প্রেসিডেন্ট রেজেব তাইয়েপ এরদোয়ানের সমালোচকরা তার বিরুদ্ধে মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করা এবং বিরোধী দলকে দমন করার অভিযোগ করেন।

আর একারণে তুর্কীরা ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয় প্রার্থনা করছে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পরিসংখ্যান বিষয়ক সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের মতে এধরনের আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা গত এক দশকে দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে তাদের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ- ২৫,০০০।

অন্যদিকে তুরস্ক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, যাদের অধিকাংশই সিরিয়া থেকে এসেছেন।

“তবে ও ই সি ডি গ্রুপের ৩৮টি সদস্য দেশের মধ্যে তুরস্ক একমাত্র দেশ যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী তৈরি হচ্ছে। এই প্রবণতা নতুন,” বলেন অধ্যাপক সিরকেচি।

“আমি এটাকে বলি এরদোয়ান-বিরোধীদের নির্বাসন। লোকজন এই সরকার ও রাজনৈতিক কাঠামোর হাত থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।”

তবে তুরস্কের সরকার যোগ্য ও মেধাবী তরুণরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে- এধরনের বর্ণনা মেনে নিতে রাজি নয়।

শ্রম ও সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ভেদাত বিলগিন অক্টোবর মাসে এক সেমিনারে এবিষয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন, “বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে তরুণরা বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। এটা খুব স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা। তারা এই বিশ্ব সম্পর্কে জানতে চায়।”

তবে আঙ্কারায় সাংবাদিকতার ছাত্রী বার্না বলছেন, তুরস্ক ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে, যদি তিনি বিদেশে চলেই যান, তার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে।

তিনি এখন সংসার শুরু করার স্বপ্ন দেখছেন, যার সঙ্গে তুরস্কে বসবাসের বিষয়টিও জড়িত।

“আমি চাই আমার সন্তানরা আমার দেশে বেড়ে উঠুক,” তিনি বলেন, “তারা যেন তুরস্কের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পায়।” সূত্র: বিবিসি বাংলা

LEAVE A REPLY