অভ্যুত্থানের এক বছরে মিয়ানমারের ‘ইতিহাসে বৃহত্তম বিক্ষোভ’

ইয়াঙ্গুনের যানবাহন ও জনশূন্য রাস্তা। জান্তার চাপেও কেউ দোকানপাট খোলেনি। ছবি-ডয়েচে ভেলে\

জান্তা সরকারের আদেশ ও হুঁশিয়ারির তোয়াক্কা না করে ‘নীরব ধর্মঘট’ পালন করে প্রতিবাদ জানিয়েছে মিয়ানমারের জনগণ। মঙ্গলবার (১ ফেব্রুয়ারি) দেশটির রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা। দোকানপাট ছিল বন্ধ।

দেশটির সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে এভাবে প্রতিবাদ জানায় মিয়ানমারের জনগণ।

সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসে এই নীরব ধর্মঘটকে দেশটির সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

এর আগে জান্তা সরকারের পক্ষ থেকে এই দিনটিকে কোনোভাবেই পালন না করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বেসামরিক নেত্রী অং সান সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত করে গণতান্ত্রিক যাত্রার অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয় সেনাবাহিনী। এরপর ব্যাপক বিক্ষোভ ও ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন শুরু হয়। একটি স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, জান্তা সরকার দেড় হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে।

সেনা অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে অভ্যুত্থানবিরোধীরা ‘নীরব ধর্মঘট’ এবং একযোগে হাততালি দিয়ে কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে জান্তা সরকার সব দোকানপাট খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছিল।

মঙ্গলবার সকাল ১০টায় ইয়াঙ্গুনের বাণিজ্যিক এলাকার রাস্তাঘাট খালি হতে শুরু করে। এএফপির প্রতিনিধি বলেন, একই দৃশ্য দেখা যায় দক্ষিণাঞ্চলের মান্দালয় শহরে।

মান্দালয়ের এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা হাততালি দিচ্ছিলাম। এরপর আমার আশপাশের বাড়িগুলো থেকেও হাততালি দেওয়া শুরু হলো। ’

মান্দালয়ের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার এলাকার আশপাশে কেউ রাস্তায় বের হচ্ছে না এবং নিরাপত্তা বাহিনী টহল দিচ্ছে। আমি নীরব ধর্মঘটে অংশ নিতে ঘরে বসে অনলাইন গেম খেলছি। ’

সেনা অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির আগে জান্তা সরকার নীরব ধর্মঘট পালনের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, মঙ্গলবার যদি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয় তাহলে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে। পাশাপাশি কোনো ধরনের মিছিল বা সেনাবিরোধী ‘প্রচারে’ অংশ নিলে রাষ্ট্রদ্রোহ বা সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হবে।

মঙ্গলবার প্রকাশিত এক মন্তব্যে জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং আবারও দাবি করেন, ২০২০ সালের ভোটে সু চির দল জালিয়াতি করেছিল। এ কারণে তাঁরা ক্ষমতা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা ওই নির্বাচনকে অনেকাংশে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে জানিয়েছিলেন।

মিন অং হ্লাইং রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারকে বলেছেন, আবার স্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নতুন নির্বাচন ডাকা হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় জান্তার তৎপরতায় জনগণ হতাশ। এতে তারা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসে দেশটির সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলছে। গতকালের দেশজুড়ে নীরব ধর্মঘটটি ছিল পরিকল্পিত।

মিয়ানমার বিষয়ক বিশ্লেষক ডেভিড ম্যাথিসন বলেন, ‘খবর অনুযায়ী মিয়ানমারের জনগণ যদি ধর্মঘট পালন করে থাকে তাহলে সেটি হলো ‘বজ্রময় নীরবতা’। এটি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি তীব্র তিরস্কার।

নিষেধাজ্ঞা : যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা গত সোমবার মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের ওপর সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সু চির বিচারে জড়িত ব্যক্তিরাও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, ‘আমরা যুক্তরাজ্য ও কানাডার সঙ্গে এই পদক্ষেপগুলো সমন্বয় করছি। ’

যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগ সাত ব্যক্তি ও দুই প্রতিষ্ঠানকে নিষেধাজ্ঞার তালিকাভুক্ত করার কথা জানিয়েছে। এর মধ্যে আছে মিয়ানমার জান্তা সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল থিদা ও’, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান।

মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত নির্বাচিত নেত্রী অং সান সু চির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারকাজের সঙ্গে এই ব্যক্তিরা জড়িত বলে অভিযোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞার কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা কোনো সম্পদ জব্দ হবে এবং আমেরিকানদের সঙ্গে তাঁদের কোনো রকম লেনদেনও নিষিদ্ধ থাকবে।

মিয়ানমারের ওই কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া দুটি সংস্থা হচ্ছে কেটি সার্ভিসেস অ্যান্ড লজিস্টিক কম্পানি লিমিটেড, যে কম্পানি জান্তাকে আর্থিক সহায়তা দেয় এবং সেনাবাহিনীর প্রকিউরমেন্ট ডিরেক্টরেট, যে প্রতিষ্ঠান জান্তার জন্য বিদেশ থেকে অস্ত্র কেনে।

সু চির আরেকটি বিচার : অভ্যুত্থানের পর থেকেই আটক রয়েছেন সু চি। এরই মধ্যে বেআইনিভাবে ওয়াকিটকি আমদানি, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উসকানি এবং কভিড-১৯ বিধি ভঙ্গ করার জন্য তাঁকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
জান্তা সরকার রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা বিষয়ক আইন লঙ্ঘনসহ আরো একগুচ্ছ অভিযোগ এনেছে সু চির বিরুদ্ধে। সব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর এক শ বছরেরও বেশি সময় কারাদণ্ড হতে পারে।

অভ্যুত্থানের ফল নিয়ে প্রশ্ন : সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার পর দেশটিতে লাখ লাখ বেকার তৈরি হয়েছে। খাদ্য ও জ্বালানির দাম বাড়ছে, বাড়ছে দারিদ্র্য। দেশটির শিক্ষা, কভিড আক্রান্তদের স্বাস্থ্যসেবা এবং ব্যাংকিং খাতগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এই ক্ষমতা দখলের ফলে লাভটা কী হলো? মিয়ানমারের স্পেশাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং দেশটিতে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বলেছেন, ‘এটি একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান। এ অভ্যুত্থান সফল হয়নি। আর সে কারণেই তারা অভ্যুত্থান শেষ করতে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। ’

LEAVE A REPLY