রাশিয়াকেও ধ্বংস করছেন পুতিন

ভ্লাদিমির পুতিন যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন পর্যবেক্ষকদের অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, এবার বুঝি রাশিয়া পাল্টাবে। পুতিন নিজেও দুর্নীতি, অনিয়ম নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছিলেন। পর্যবেক্ষকদের ধারণা আর পুতিনের অঙ্গীকার দুই-ই উল্টো পথে হাঁটতে সময় নেয়নি। সমালোচকরা বলে থাকেন, পুতিন বরং রুশ রাষ্ট্রযন্ত্রকে একেবারে নিজের মতো করে সাজানোর কাজে মন দিয়েছিলেন শুরু থেকেই।

তাঁর সেই সাজানো রাষ্ট্রযন্ত্রই ইউক্রেনে ‘বিশেষ অভিযান’ বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।

সিএনএনের বিশ্লেষক নিক রবার্টসন পুতিনের কর্মকাণ্ডকে নাৎসি বাহিনীর তৎপরতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর মতে, বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে জার্মানিতে নাৎসিরা যা করেছিল, বর্তমানে পুতিন সেভাবেই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সাজিয়ে নিয়ে কাজ চালাচ্ছেন। এক কথায়, রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান তাঁর নির্দেশ পালনে প্রস্তুত। ইউক্রেন ও পুতিনের নিজের দেশ রাশিয়া—দুই জায়গায় একসঙ্গে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে তার সেই সদা প্রস্তুত বাহিনী।

একদিকে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হামলায় সামরিক হতাহতের পাশাপাশি প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশে সেসব নিরীহ প্রাণ ক্ষয়ের প্রতিবাদ জানাতে বিক্ষোভে ফেটে পড়া রুশদের ওপরও নেমেছে খড়্গ। রুশ পুলিশের তৎপরতার চিত্র তুলে ধরে রবার্টসন জানান, ইউক্রেনে অভিযান শুরুর প্রথম সপ্তাহে রাশিয়ায় প্রতিদিন এক হাজারের বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নারী-পুরুষ, তরুণ-বৃদ্ধ নির্বিশেষে রুশরা পুলিশের হাতে মার খেয়েছে। পুতিনের শাসনামলে ‘সুপ্রশিক্ষিত, ভালো বেতনপ্রাপ্ত মানবযন্ত্ররা’ অনায়াসে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবেশী দুই দেশের জানমালের ক্ষতির শিকার হচ্ছে নিরপরাধ মানুষ এবং উভয় ক্ষেত্রেই দায় রাশিয়ার।

রবার্টসনের মতে, পুতিন যা করেছেন, যে তিক্ততার বীজ বুনেছেন, সেখান থেকে রাশিয়াকে বের করে আনা মোটেই সহজ হবে না।

রাষ্ট্রব্যবস্থার পাশাপাশি রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে রবার্টসন তাঁর নিবন্ধে লেখেন, পুতিনের দীর্ঘ শাসনামলে সংবাদমাধ্যম এমনিতেই ধুঁকছিল। দুই বছর আগে যখন কট্টর পুতিনবিরোধী নেতা আলেক্সেই নাভালনিকে বিষপ্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয়, তখন থেকে রীতিমতো ‘লাইফ সাপোর্টে’ রয়েছে রাশিয়ার স্বাধীন সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারের সমালোচনা করলেই ১৫ বছরের কারাদণ্ডের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে মিডিয়া।

গুটিকয়েক যে স্বাধীন সংবাদ প্রতিষ্ঠান রাশিয়ায় ছিল, সেগুলোর একটি  টিভি রেইন। মাসখানেক আগে সেই টেলিভিশনের এক উপস্থাপিকা জানিয়েছিলেন চরম অনিশ্চয়তার কথা। বলেছিলেন, ‘আগামীকাল টিভি স্টেশনটা থাকবে কি না, সম্প্রচারে যাবে কি না, তা-ও কখনোই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। ’ তাঁর আশঙ্কা সত্যি করে ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর কয়েক দিনের মধ্যে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই উপস্থাপিকা, তাঁর সম্পাদক স্বামী ও সন্তানরা এখন পরবাসী। এ ধরনের মানুষ একে একে দেশ ছাড়লে রাশিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে—এমনটাই অভিমত রবার্টসনের।

সিএনএনের এই বিশ্লেষক মনে করেন, ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নাম দিয়ে পুতিন ইউক্রেনে যা করছেন, সেই একই কাজ তিনি সিরিয়া, চেচনিয়া আর জর্জিয়াতেও করেছেন। আর এখন তিনি ইউক্রেনেই সীমাবদ্ধ থাকবেন কি না, তা নিয়ে সন্দিহান এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। তিনি প্রশ্ন রাখেন, পুতিন ন্যাটোর সীমানায়ই থমকে দাঁড়াবেন নাকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেবেন? এ ব্যাপারে তাঁর মনে প্রশ্ন থাকলেও পুতিন যে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ারও ধ্বংস ডেকে আনছেন, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। আর যুদ্ধটা যে রাশিয়ার নয়, বরং স্রেফ পুতিনের, সেটাও হলফ করেই বলছেন এই বিশ্লেষক।

LEAVE A REPLY