আকাশপথে পণ্য পরিবহণে ভয়াবহ জট

হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের স্ক্যানারগুলো বছরের বেশিরভাগ সময় বিকল থাকে। একবার বিকল হলে মেরামতে সময় লাগে ১ থেকে ২ মাস। এতে প্রতিবারই পণ্য পরিবহণে ভয়াবহ জট তৈরি হয়। শুধু স্ক্যানার মেশিন নষ্ট হওয়া নয়, এখানে রয়েছে দক্ষ জনবলের অভাবও। ওজন মাপার মেশিনগুলোও রহস্যজনক কারণে বারবার বিকল হয়ে যায়।

অভিযোগ আছে, স্ক্যানার ও ওজন মাপার মেশিন নষ্ট থাকার এ সুযোগে একটি সিন্ডিকেট ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাদকসহ বিভিন্ন অবৈধ পণ্য পাচার করছে। সিন্ডিকেটের সঙ্গে স্ক্যানার মেশিন অপারেটর, নিরাপত্তাকর্মী, লোডারসহ কার্গো বিভাগের বিভিন্ন শাখার অসাধু কর্মকতা-কর্মচারী জড়িত। একাজে তারা বিপুল অঙ্কের টাকা ভাগ পায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিদিন এখন ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি কার্গো ডেলিভারি করতে হচ্ছে। আগে প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০টি কার্গো ফ্লাইট থাকলেও এখন গড়ে শিডিউল নন-শিডিউল মিলে অর্ধশতাধিক ফ্লাইট ওঠানামা করছে। গত এক সপ্তাহ ধরে রপ্তানি কার্গো কমপ্লেক্সের ইডিএস স্ক্যানার (এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম) নষ্ট হয়ে আছে। পণ্য স্ক্যানিংয়ে এখন একমাত্র ভরসা ৪ কুকুরের ডগ স্কোয়াড। যার কারণে গোটা ইউরোপে পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে। বিকল ইডিএস মেশিনটি কখন সচল হবে তাও কেউ জানেন না।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমন ধীরগতি চলতে থাকলে ঝুঁকিতে পড়বে বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আদেশ। অপরদিকে স্ক্যানিংয়ে সমস্যার কারণে যদি ইউরোপের কোনো দেশে বিস্ফোরকসহ মাদকের চালান ধরা পড়ে তাহলে যে কোনো সময় ফের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে কার্গো পরিবহণ।

জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডের পোশাক ক্রেতাদের তুমুল চাহিদার কারণে কনটেইনার কার্গোর চাপ বেড়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এ কারণে বিমানবন্দরকে সক্ষমতার চেয়ে দেড়গুণ বেশি কার্গো সামলাতে হচ্ছে। রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের কনটেইনার জট এবং চড়া কার্গো শিপিং চার্জের কারণে ক্রেতা ও রপ্তানিকারকরা আকাশপথে পণ্য পরিবহণে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু বিমানবন্দরের দুই স্ক্যানার ও ওজন মাপার মেশিন বিকল থাকায় রপ্তানিতে তৈরি হয়েছে বড় জট।

ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা জানিয়েছেন, শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে এখন যেসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে তার ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক। তাদের মতে, বিস্ফোরক শনাক্তকরণ যন্ত্র বিকল থাকায় তাদের পণ্য ডেলিভারিতে নানা সমস্যা হচ্ছে। তা ছাড়া কার্গো কমপ্লেক্সের সামনে পণ্যের জট থাকায় অনেক দূর পর্যন্ত ট্রাকের লাইন তৈরি হয়। এ জট পেরিয়ে সময়মতো মালামাল ডেলিভারি দিতে পারছে না। এতে দেশের বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি কার্গো শিল্প এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সংগঠন ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রডাক্ট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ বলেন, বিমানবন্দরে এক কেজি পণ্য স্ক্যানিং করতে ৬ সেন্ট ফি দিতে হয়। আর প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ টন কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়। ফলে এক সপ্তাহে যে ফি আদায় হয় তা দিয়ে এরকম ৪টি স্ক্যানার মেশিন ক্রয় করা যায়।

তিনি বলেন, এর আগে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার বলা হয়েছে তারা নিজদের খরচে স্ক্যানার মেশিন কিনে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাতে সায় দিচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, পণ্য রপ্তানি না হওয়ায় এসব সবজি এখন স্থানীয় বাজারে কম দামে বিক্রি করতে হয়। অন্যদিকে পণ্য না যাওয়ায় ইউরোপের বাজার হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিএফভিএপিইএর তথ্যানুযায়ী-বাংলাদেশ থেকে লাউ, শিম, চিচিঙ্গা, জালি, পটোল, কাঁকরোল, শসা, কচু, লতি, আমড়া, জলপাই, লেবু ইত্যাদি সবজি ইউরোপসহ মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ায় রপ্তানি হয়।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ড অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, একটি ইডিএস (এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম) মেশিন কিনতে খরচ পড়ে ৫-৬ কোটি টাকা। অথচ এই ইডিএস মেশিনের কারণে শত শত কোটি টাকার পণ্যের আদেশ বাতিল হয়ে যায়। এরপরও রহস্যজনক কারণে সরকার ও সিভিল এভিয়েশনের টনক নড়ে না।

তিনি আরও বলেন, বাপার পক্ষ থেকে সিভিল এভিয়েশনকে অসংখ্যবার বলা হয়েছে বাপা নিজেদের খরচে এ মেশিন বসাবে, দক্ষ জনবল দিয়ে এই মেশিন পরিচালিত করবে। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বসে বসে কমিশন পাবে আর মনিটরিং করবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বাপাকে এ ক্ষমতাও দিচ্ছে না, আবার নিজেরাও কিছু করতে পারছে না। তার মতে, যদি বাপা এটা পরিচালনার সুযোগ পেত তাহলে কোনো পণ্যের জট হতো না। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও আরও শক্তিশালী হতো।

বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে আন্তর্জাতিকমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই জানিয়ে ২০১৬ সালের ৮ মার্চ কার্গোবাহী সরাসরি ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেয় যুক্তরাজ্য। পরে তাদের পরামর্শে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান রেডলাইন অ্যাসিউর্ড সিকিউরিটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে বেবিচক। এরপর বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়। বসানো হয় আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি। যুক্ত হয় ডগ স্কোয়াড। এরপর যুক্তরাজ্যসহ সব দেশ কার্গো পণ্য পরিবহণে তাদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

বর্তমানে কার্গো কমপ্লেক্সে থাকা দুটি ইডিএস মেশিন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। পণ্যের চাপ বেশি পড়লে দুটি যন্ত্রেই ত্রুটি দেখা দেয়। জানা গেছে, এক মাস ধরে একটি ইডিএস মেশিন পুরোপুরি নষ্ট। অপর মেশিনটিও বেশির ভাগ সময় বিকল থাকে। ইডিএস মেশিন অচল হওয়ায় ডিএমপির কুকুর (ডগ স্কোয়াড) দিয়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে (ইডিডি) পণ্য তল্লাশি কার্যক্রম চালানো হয়। এতে পণ্য রপ্তানিতে ধীরগতি তৈরি হয়। এভাবে পুরো কার্যক্রমে ধস নেমে এসেছে।

বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাসে বাংলাদেশ পোশাক পরিবহণের সুবাদে ৩.৩৮ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। গত অর্থবছরে এই আয়ের পরিমাণ ছিল ২.৯৭ বিলিয়ন ডলার। পোশাক আইটেমের সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ার কারণে আগের মাস থেকে আগস্টে যুক্তরাজ্যে খুচরা বিক্রি কমা অব্যাহত ছিল। তবে বর্তমানে বিক্রির পরিমাণ ০.৭ শতাংশ হারে বাড়ছে।

LEAVE A REPLY