কঠোর তদারকিতে জোর

তিন কারণে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বেড়েছে। এগুলো হচ্ছে-করোনার প্রকোপ কমার পর হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে টাকার প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়া। এসব কারণে চলতি অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে। এ চাপ সহনীয় পর্যায়ে রাখতে অর্থনীতির সব খাতে কঠোর তদারকি বাড়াতে হবে। কেননা করোনার প্রকোপ কমলেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিপূর্ণভাবে পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে এখনও ঝুঁকির আশঙ্কা রয়ে গেছে।

সোমবার রাতে প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২০-২১’ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গত অর্থবছর শেষ হওয়ার প্রায় ৯ মাস পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করল। আগে প্রতিবেদনটি সাধারণত সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে প্রকাশিত হতো। করোনার কারণে অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন হতে দেরি হওয়ায় প্রতিবেদনটি প্রকাশ করতে দেরি হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র। প্রতিবেদনে অর্থনীতির সব খাতের গত অর্থবছরের তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির গতিবিধিও তুলে ধরা হয়েছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থানও রয়েছে এতে। চলতি অর্থবছরের অর্থনীতির একটি পূবাভাস ও করণীয় সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় চাহিদা কমে গিয়েছিল। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম কমে গিয়েছিল। গত বছরের শেষ দিকে করোনার প্রকোপ কমায় হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও সচল হতে থাকে। বাড়তে থাকে পণ্যের দাম। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। অন্যান্য প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। পণ্যের দাম বাড়ার কারণে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির নামে দেশ মূল্যস্ফীতি আমদানি করছে। এতে দেশেও মূল্যস্ফীতির হারে চাপ বেড়েছে। একই সঙ্গে দেশের বাজারেও পণ্যের দাম বেড়েছে। এতেও মূল্যস্ফীতি উসকে দিচ্ছে। করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব প্যাকেজের দ্বিতীয় পর্যায় এখন চলছে। কোনো কোনো প্যাকেজের তৃতীয় পর্যায় চলছে। প্যাকেজ বাস্তবায়নের কারণে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানো হয়েছে। এটিও মূল্যস্ফীতির হার বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এসব মিলে আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ হার কমাতে ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি এগিয়ে নিতে হলে অর্থনীতির সব খাতে কঠোর তদারকি অপরিহার্য। কেননা করোনাভাইরাসের প্রভাবে যে ক্ষতি হয়েছে তা থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিপূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার করতে ঝুঁকির মাত্রা এখনও উড়ে যায়নি। নানাভাবে পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে ঝুঁকি আসতে পারে। সেদিক থেকে সতর্ক থাকতে হবে।

এতে আরও বলা হয়, গত দুই বছর করোনার কারণে দেশে অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স প্রবাহ, কৃষি ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়ায় দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার মানও ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে দরিদ্র ও বস্তি এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে সরকারের পদক্ষেপের ফলে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনার টিকার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে অর্থনীতি প্রত্যাশার বেশি গতিতে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আরও মনোযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে টাকার প্রবাহ সব খাতেই বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখার ওপর জোর দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করেছে। গত অর্থবছরের শুরুর দিকে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৭৯৪ কোটি ডলার ক্রয় করেছে। অর্থবছরের শেষ দিকে আমদানির দেনা পরিশোধের চাপ বাড়ায় চাহিদার জোগান দিতে ব্যাংকগুলোর কাছে ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। বছর শেষে এসে ডলারের দাম বাড়ায় টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন হয়েছে।

সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যকার ব্যবধান কমানোর উদ্যোগ নিয়েও সফলতা মিলছে না। গত অর্থবছরে এ ব্যবধান আগের চেয়ে বেশি বেড়েছে। বিনিয়োগের চেয়ে সঞ্চয় বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু এখন বিনিয়োগের চেয়ে সঞ্চয় কম। ফলে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ব্যবধান বেড়েই চলেছে।

প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার চলতি অর্থবছরে কমবে। গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে তা কমে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার কমলেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৬ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রবৃদ্ধির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে বাংলাদেশ। প্রথম স্থানে থাকবে ভারত। তাদের প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৮ শতাংশ। তবে তা গত অর্থবছরের চেয়ে কম। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের চেয়ে কম হবে।

মূল্যস্ফীতির হার বাংলাদেশে বাড়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি হবে পাকিস্তানে। দ্বিতীয় অবস্থানে শ্রীলংকা, তৃতীয় অবস্থানে ভারত।

LEAVE A REPLY