অস্কার মঞ্চে চড়, বাংলাদেশে তোলপাড়!

স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে উইল স্মিথ

৯৪তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের দর্শক সারি থেকে মঞ্চে উঠে সঞ্চালক ক্রিস রককে চড় মারেন উইল স্মিথ। তার আগে ক্রিস রসিকতা করে ফেলেন উইল স্মিথের স্ত্রী জাডা পিংকেট স্মিথকে নিয়ে। বলেন, পরের ‘জি আই জেন’ ছবিতে অভিনয় করবেন জাডা। ১৯৯৭ সালের সেই ‘জি আই জেন’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ডেমি মুর।

ছবিতে তার মাথায় চুল ছিল না। ঘটনাচক্রে জাডার মাথায়ও চুল নেই। কিন্তু সেটি একটি অসুখের কারণে। যে অসুখের নাম অ্যালোপেসিয়া (Alopecia)।

এ ইস্যুতেই রেগে যান উইল স্মিথ। মঞ্চে উঠে পড়েন এবং চড় মারেন ক্রিসকে। এরপর ‘কিং রিচার্ড’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার অস্কার পান তিনি। সেই সময় নিজের আচরণের জন্য ক্ষমাও চেয়ে নেন। যুক্তরাষ্ট্রের ডলবি থিয়েটারের অস্কার মঞ্চের এই ঘটনা বাংলাদেশেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। চড় মারার ঘটনা নিয়ে দেশের সোশ্যাল মিডিয়া অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে গেছে।  অধিকাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারী এ বিষয়ে নিজেদের অভিমত প্রকাশ করছেন।  পক্ষে-বিপক্ষে অনেকেই লিখছেন। সব পেশার মানুষই নিজের অভিমত প্রকাশ করছেন।

ওমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদক সুপ্রীতি ধর চড় মারার বিষয়টি সমর্থন করছেন না। তিনি বলছেন- 

অধিকাংশই উইল স্মিথের চড় মারাকে তার ‘পৌরুষ’ হিসেবে দেখছে, আমার আপত্তি এখানেই। বউয়ের ‘সম্মান’ রক্ষার্থে স্টেজে উঠে উপস্থাপককে চড় মারার মধ্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে পৌরুষত্বের কিছু দেখছি না। ডার্ক হিউমার বুঝতে না পারলে আরো অনেক উপায় ছিল এর উত্তর দেওয়ার। কিন্তু তা না করে স্মিথ তার মাচোগিরিই শো করল। একটা অন্যায়কে জাজ করা হলো আরেকটা অন্যায় দিয়ে। তা ছাড়া যাকে বলা হলো সেও পারত এর সমুচিত প্রতিবাদটুকু জানাতে, কিন্তু তাকেও ‘স্বামী’র কৃতকর্মের জন্য কুণ্ঠিত হতে দেখলাম না।

ক্রিস রক কমেডিয়ান। সেদিনই ক্লাসে তার একটি ভিডিও দেখিয়ে বর্ণবাদ নিয়ে আলোচনা করতে বলা হয়েছিল আমাদের। সেখানে সে বলেছিল, খুবই দুর্ভাগা সে, কারণ এমন একটা অনুষ্ঠান তাকে উপস্থাপনা করতে হচ্ছে যেখানে একজন কৃষ্ণাঙ্গও পুরস্কার পাচ্ছে না, সেটা নিয়ে সে হাস্যরসের মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা করেই বলেছিল। আমাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘এমন একটা সুযোগ পেলে তুমি কি করতে অনুষ্ঠান?’ আমার উত্তর ছিল, ‘করতাম। কারণ এই কথাগুলো বলার জন্য হলেও সুযোগটা কাজে লাগাতাম। ‘

আমার এত কথা বলার কারণ দুটো। ক্রিস রক কমেডিয়ান আর তারা অনেক কিছু নিয়েই ডার্ক জোকস করে। কারো বিরুদ্ধে গেলে বা পছন্দ না হলে এর উত্তর দেওয়ার হাজারটা পদ্ধতি আছে, প্রয়োজনে মামলা করা যায় মানহানির।  
দ্বিতীয়ত, একাডেমি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানটা কলঙ্কিত হয়ে গেল এই একটিমাত্র ঘটনায়। এখনো যেখানে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার বলে চিল্লাইতে হয়, সেখানে এমন একটা ঘটনা বেশ ‘ঘটনাবহুল’ই হবে শেষ পর্যন্ত, যদিও ক্রিস রক কোনো অভিযোগ আনতে রাজি হননি।  কিন্তু ঘটনাটা সবার সামনেই ঘটেছে, সবাই দেখেছে, সবারই মতামত আছে এবং এর একটা রেশও আছে। তা ছাড়া প্রথমে কিন্তু স্মিথ এবং তার স্ত্রী দুজনই হেসে দিয়েছিলেন। মানে, মেনে নিয়েছিল। তাদের হাসি দেখে রকও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল!

মুহূর্তের রাগ, ক্ষোভ যে সর্বনাশ ডেকে আনে, স্মিথও তা জানেন।  সে জন্যই সে বলতে বাধ্য হয়, সে আশা করছে একাডেমি তাকে আরো ডাকবে সামনে। ক্রিসের অপমানজনক জোকসের চেয়েও আসল ঘটনা এখন স্মিথের চড় মারা। বল আসলে এখন ক্রিসের ঘরেই।
মুখের কথার জবাব মুখ দিয়েই দেওয়া উচিত, শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করে না। এটা গ্রামের কোনো খেলার মাঠও না, এটা অস্কার পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠান।  
Sorry, I couldn’t support Will Smith’s move against Chris Rock. I also do not support such humor of Rock.

শাওন মাহমুদ নিজের ফেসবুকে ঘটনাটি শেয়ার করে লিখেছেন, পৃথিবীর সকল পুরুষেরা উইল স্মিথের মতন হোক। অভিনন্দন উইল স্মিথ। ভালোবাসা।

অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন বলছেন, আমারও মাঝেমধ্যে এ রকম চড় দিতে ইচ্ছা করে।   আফসোস… দিতে পারি না।

চড় মারার বিষয়কে আরো বিশ্লেষণ করে নাজনীন হাসান চুমকি লিখেছেন, চড় সে-ই দিয়েছে, যে চড় দিলে বিশ্বে আলোচনা & সমালোচনাও যদি হয় ঐ ব্যক্তির কোনও মাথাব্যথা হয় না…
যদি বাংলাদেশের কথা বলি। নিজ দেশের কথা ভাবুন… প্রতিদিন কত শত-সহস্র-লক্ষ নারী স্বামীর অগণিত অ-কাজ, কু-কাজ মনের অতলে প্রাণভোমরা করে বাঁচিয়ে রেখে, আত্মীয়-স্বজনের সাথে হাসিমুখে স্বামীর সুনামের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। অথচ স্বজনদের অনেকেই জানেন সেই নারীর অসহায়ত্ব। তবুও স্বামী সচেতন নারী দায়িত্ব পালন করে চলেছে- সেটা কি স্বামীকে সাপোর্ট করা, সম্মান করা না? কই সেসব নিয়ে তো আমরা Appreciate করি না!

আর। স্বামী স্ত্রীকে সাপোর্ট করলে তো কথায় নেই… আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সমাজ সেই পুরুষকে কাপুরষ, বউভাতারি, মাইগ্গা ইত্যাদি ইত্যাদি কত বিশেষণে আখ্যায়িত করি। ঐ ভদ্রলোক Appreciation খুব কমই পায়। তো, সেই পুরুষেরা কি স্ত্রীকে সম্মান করে না? সাপোর্ট করে না? কিন্তু আজ তো।   বিষয়টা আন্তর্জাতিক… তাই আমরা আলোচনায় মুখর.. হ্যাশট্যাগ “সাপোর্ট” লিখছি। বেশি কিছু না। সেই সুদূরে বসে অভিনেতার আপনাদের সাহসের দরকার নেই…পারলে নিজ দেশে সাহস দেখান। আজ যদি অভিনেতাকে আপনাদের সাহসী মনেই হয়। তার মতো, পারলে ঘরে-বাইরে-প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিদিন চোখের সামনে নারীদেরকে অপমান করা পুরুষদেরকে থাপ্পড় দিন… প্রতিবাদ করুন।   নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, আপনাদেরকে বলছি- ফেসবুকে শুধু লিখেন না, পারলে সাহসটা দেখান… তখন আপনার & আপনাদের জন্যেও হ্যাশট্যাগ “সাহস” লিখতে ভালো লাগবে।  

কথাসাহিত্যিক রুমানা বৈশাখী লিখেছেন, সেই সমাজে উইল স্মিথ কেন অস্কারে গিয়ে মারপিট করলেন, সেটা অনেকেই বুঝবেন না। পৃথিবীর সকল ব্যাপার নিয়ে যে রসিকতা করা চলে না এই পরিমিতিবোধ অনেকেরই নেই। কারো একটা অসুস্থতা কিংবা ত্রুটি নিয়ে যেকোনো পরিস্থিতিতেই রসিকতা করা চলে না, এটা বোঝার মতো রুচিবোধ খুব বেশি মানুষ ধারণ করেন না।   উইল স্মিথ বরাবরই আমার প্রিয়। যেমন শান্তভাবে হেঁটে গিয়ে থাপ্পড়টা দিয়েছেন, তাতে আরো ভালো লেগেছে। আরো ভালো অস্কার জেতার পরের স্পিচটা। নিউজফিড ঘুরলেই পেয়ে যাবেন। দেখে নিয়েন।

কথাসাহিত্যিক মাহবুব মোর্শেদ চড়ের বিষয়টি সমর্থন করেননি।   তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ক্রিস রকের কথা অবশ্যই আপত্তিকর ছিল। কিন্তু উইল স্মিথ স্টেজে উঠে তাকে চড় মেরে ঠিক করেন নাই। উনি বরং পুরস্কার নেওয়ার পর তার স্পিচে ক্রিস রকের সমালোচনা করতে পারতেন। ক্রিস রক যেটা করছেন সেটা হলো বডি শেমিং আর উইল স্মিথ করেছেন পৌরুষের প্রদর্শন। ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে গিয়ে উইল স্মিথ পুরো স্পিচ জুড়ে যে কাঁদলেন সেটাও ভালো হয় নাই।  

সংগীত পরিচালক প্রিন্স মাহমুদ এই চড়ের পক্ষে মত প্রকাশ করে নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, উইল স্মিথের চড়টি কেবল ‘চড়’ নয়, প্রতিটি মানুষের জন্য একটা সতর্কীকরণ। কোনো মানুষের অসুস্থতা নিয়ে হাস্য-রঙ্গ, ঠাট্টা-উপহাস না করার সতর্কীকরণ এবং শিক্ষা।

তাদের মতামতের ওপরও নেটিজেনরা নিজেদের মত প্রকাশ করছেন।  

LEAVE A REPLY