ফুটবল বিশ্বে মেসি-নেইমারদের ছাড়িয়ে আলোচনার শীর্ষে এখন ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে। রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বিশ্বকাপে ফ্রান্সকে বিশ্কাবপ উপহার দেয়া এই ফরোয়ার্ড তখন থেকেই সবার নজরে ছিলেন। দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের পরপরই তাকে দলে নিতে উঠেপড়ে লাগে ইউরোপ ও ফ্রান্সের খ্যাতনামা ক্লাবগুলো। তবে শেষ পর্যন্ত ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মেইতে (পিএসজি) নাম লিখিয়েছেন তিনি। এরপর থেকে এখনো পর্যন্ত পিএসজির জার্সি গায়ে একের পর এক সাফল্য অর্জন করছেন এই ফরাসি ফরোয়ার্ড। পিএসজির জার্সিতে ফরাসি ক্লাব টুর্নামেন্ট লিগ ওয়ানে ২০১৭-১৮ মৌসুম থেকে তাকে দেখা গেছে। একের পর এক মৌসুমে নিজেকে আরো অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। গোলের ধারাবাহিকতা অন্যান্য ক্লাবগুলোকে তার দিকে চোখ রাখতে বাধ্য করছে। প্রতিপক্ষের সঙ্গে দল একটি গোল পেলেও অধিকাংশ সময় সে গোলটি আসে এমবাপ্পের পা থেকে।
২০১৭-১৮ মৌসুমে ২৭ ম্যাচে ৮ অ্যাসিস্টের সঙ্গে পেয়েছেন ১৩ গোল। বিশ্বকাপ জয়ের পর ১৮-১৯ মৌসুমে এই পরিসংখ্যানকে প্রায় তিনগুণ বাড়িয়েছেন তিনি। লিগ ওয়ানে ২০১৮-১৯ মৌসুমে ২৯ ম্যাচে ৭ অ্যাসিস্টের সঙ্গে গোল পেয়েছেন ৩৩টি। এরপর থেকে এমবাপ্পের সাফল্যের ধারা আর প্রতিহত হয়নি কোথাও। ১৯-২০ মৌসুমে ১৮ গোল ২০-২১ মৌসুমে পেয়েছেন ২৭ গোল। চলতি মৌসুমে পিএসজির জার্সি গায়ে এমবাপ্পে সতীর্থদের মধ্যে বিশ্বের খ্যাতনামা ফুটবলার লিওনেল মেসি ও ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমার জুনিয়রও আছেন। তবুও এমবাপ্পের সাফল্য লাভে বিন্দুমাত্র সমস্যা হচ্ছে না। বরং মেসি-নেইমাররা যে ম্যাচে গোলের দেখা পায় না, সে ম্যাচেও গোল পাচ্ছেন এমবাপ্পে।
চলতি মৌসুমে বার্সা থেকে পিএসজিতে পাড়ি জমিয়েছে আর্জেন্টাইন তারকা লিওনেল মেসি। এরপর থেকেই গুঞ্জন উঠেছে পিএসজি থেকে চলে যাবেন এমবাপ্পে। অবশ্য এর আগে থেকেই এই গুঞ্জন উঠেছিল দলবদলের পাড়ায়। গত মৌসুমে গ্রীষ্মকালীন দলবদলের সময় স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ এমবাপ্পেকে দলভুক্ত করার জন্য কয়েকধাপে প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে প্রতিবারই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল পিএসজি। এর মধ্যে এমবাপ্পে নিজের মুখেই বলেছিলেন ক্লাব ছাড়ার কথা। তবে রিয়াল মাদ্রিদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার যে গুঞ্জন উঠেছিল তা অস্বীকার করেছিলেন তিনি নিজেই। সে সময়ে ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যম আএমসি স্পোর্টকে তিনি বলেছিলেন, আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম। সেই মুহূর্তে চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে চাইনি। ক্লাব যেন দলবদলের অর্থ দিয়ে মানসম্পন্ন বিকল্প আনতে পারে সেদিকটিও ভেবেছিলাম। চলতি মৌসুমে পিএসজির সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে যাবে পিএসজির। তাই বিষয়টি নিয়ে আবারো ফুটবল পাড়ায় গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক মাসে যেখানে অধিকাংশ ফুটবল ভক্ত ধরেই নিয়েছেন কিছুদিন পর থেকেই রিয়ালের জার্সিতে এমবাপ্পেকে দেখা যাবে। সহস্র রিয়াল ভক্তদের এরকম স্বপ্নে যেন পানি ঢেলে দিয়েছেন এমবাপ্পে নিজেই। লিগ ওয়ানের সর্বশেষ ম্যাচে লিয়েঁর বিপক্ষে ৫-১ গোলের জয়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে উত্তরে বলেছিলেন পিএসজির সঙ্গে চুক্তি নবায়নেরও সম্ভাবনা আছে তার। সম্প্রতি সময়ে এই এমবাপ্পেকে ঘিরেই আরো উত্তেজনা বেড়েছে। একদিকে রিয়াল মাদ্রিদ তাকে যে কোনোভাবে দলভুক্ত করতে চায়। অন্যদিকে পিএসজির ক্লাব সভাপতি তাকে দলে ধরে রাখতে চায় যে কোনো মূল্যে। এমনকি কিছুদিন আগেই চুক্তি নবায়ন করার জন্য এমবাপ্পেকে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে ক্লাবটির সভাপতি নাসির আল খেলাইফি। ফরাসি দৈনিক লা প্যারেসিয়ান এক প্রতিবেদনে বলেছে, এমবাপ্পেকে বছরে ৫০ মিলিয়ন ইউরো বেতনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যা টাকার অঙ্কে যা সাড়ে চারশ কোটিরও বেশি। এছাড়া ক্লাব পরিবর্তন না করে চুক্তি নবায়ন করলে এমবাপ্পে বোনাস পাবেন আরো ১০০ মিলিয়ন ইউরো। কাতারি মালিকানাধীন ক্লাব পিএসজি ও কাতার স্পোর্টস ম্যানেজম্যান্ট গ্রুপের ইচ্ছে এমবাপ্পেকে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকের ফুটবলার করবে। যদিও পিএসজিতে এখন সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পেয়ে থাকে ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমার জুনিয়র। এরপরে আছেন আর্জেন্টাইন তারকা লিওনেল মেসি এবং তৃতীয় নম্বরে আছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। শুধু টাকার অঙ্কই বাড়িয়েছেন যে তা নয়। পিএসজির অধিনায়কত্বের দায়িত্ব দিবেন বলেও জানিয়েছেন এমবাপ্পেকে।
শুধু ক্লাব সভাপতিই নয়, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁও এমবাপ্পেকে পিএসজি না ছাড়তে অনুরোধ করেছেন। নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত সময় পার করলেও তিনি এমবাপ্পের ওপর কঠিন নজর রেখেছেন। তাই তিনি সময়মতোই মেসি-নেইমারদের সঙ্গ না ছাড়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। ফরাসিদের এই পোস্টার বয় দেশের ক্লাব ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে খেলুক তাও চান না ফরাসি প্রেসিডেন্ট। এত সব প্রস্তাব ও অনুরোধের সঙ্গে এমবাপ্পের পরিবারের সদস্যরাও চুক্তি নবায়নের সিদ্ধান্তে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এরপরও যদি এমবাপ্পে চুক্তি নবায়নের পরিবর্তে রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমায় তাহলে পরিবার এমনকি দেশের প্রেসিডেন্টে অনুরোধকে উপেক্ষা করে তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
এমবাপ্পেকে দলে ভেড়াতে যে ক্লাবটি সবার থেকে এগিয়ে আছে তা হলো লস ব্ল্যাঙ্কোস খ্যাত স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ। বিগত দুই মৌসুম ধরেই তারা এমবাপ্পেকে সাদা জার্সিতে মাঠে নামানোর জন্য মরিয়া হয়ে আছে। সুযোগ পেলেই সবার আগে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে এই ফরাসি তারকাকে দলে নিবে রিয়াল। আর্থিক সংকটে থাকলেও সর্বশেষ দলবদলে ভারানেকে ৫০ মিলিয়ন ইউরো, ওডেগার্ড ৪০ মিলিয়ন ইউরো, আশরাফ হাকিমি ৪৫ মিলিয়ন ইউরো এবং এর আগের মৌসুমে সার্জিও রেগুইলনকে বিক্রি করে ৩০ মিলিয়ন আয় করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। এছাড়া যুব দলের আরো কয়েকজনকে বিক্রি করে ২০০ মিলিয়ন ইউরো নিয়ে এমবাপ্পেকে দলভুক্ত করার লক্ষ্যে অধীর আগ্রহে বসে আছে স্প্যানিশ ক্লাবটি। দেশের জার্সিতে সতীর্থ হয়ে খেলা রিয়াল মাদ্রিদের গোল মেশিন করিম বেনজেমাও রিয়ালের জার্সিতে এমবাপ্পেকে পেতে ইচ্ছুক। তার বিশ^াস, ফ্রান্স সতীর্থকে পেলে তার দল দুই বা তিন গুণ বেশি গোলের দেখা পাবে। কেননা জাতীয় দলের হয়ে দুজনে মিলে দেশকে বিশ^কাপ জয় করে দিয়েছেন। সেখান থেকেই তাদের মধ্যকার রসায়নও ভালো। সেদিক থেকেই ক্লাবেও এমবাপ্পেকে সতীর্থ হিসেবে দেখতে চায় বেনজেমা। অবশ্য পিএসজি ও রিয়াল মাদ্রিদ দুই ক্লাব যেন ফরাসি ফুটবলারদের কৃতিত্বেই জয়ী হয়। সর্বশেষ উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলোতে পার্ক দে প্রিন্সেসে এমবাপ্পের গোলেই জয় পেয়েছিল পিএসজি। এরপর দ্বিতীয় লেগে আরেক ফরাসি ফরোয়ার্ড করিম বেনজেমার হ্যাটট্রিকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে ছিটকে গেছে পিএসজি। গ্রীষ্মকালীন দলবদলের মৌসুম শেষ হওয়া অব্দি বলাই যায়, এই কয়েক মাস এমবাপ্পেই ফুটবল পাড়ায় আলোচনার শীর্ষে থাকবেন।