ঈদের আগেই হু হু করে দাম বাড়ছে চিনিগুঁড়া চালের

সুগন্ধযুক্ত চিনিগুঁড়া চাল ব্যবহার হয় প্রধানত বিয়েশাদি ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বা বিশেষ কোনো উপলক্ষে। সাধারণভাবে খাওয়ায় চিনিগুঁড়া চালের ব্যবহার হয় না বললেই চলে। কিন্তু রমজান শুরুর আগে থেকেই হু হু করে বাড়ছে এই সুগন্ধি চালের দাম। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এই চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ১২ টাকা।

কিন্তু কী এমন হলো যে সুগন্ধি চালের দাম এত বেড়েছে? রমজানে এমনিতেই চাহিদা কম থাকায় সাধারণ চালের দাম কমতি থাকে। রমজানে ফিরনি, পায়েসসহ বিভিন্ন খাদ্য তৈরিতে সুগন্ধি চালের ব্যবহার বাড়ে এটা ঠিক, কিন্তু চাহিদা এত বেশি বাড়েনি যে হু হু করে দাম বাড়বে।

দেশের বড় শিল্প গ্রুপগুলো চিনিগুঁড়া চাল প্যাকেটজাত করে বিক্রি শুরু করেছে আগেই। গত কয়েক বছরে অনেক শিল্প গ্রুপ এই ব্যবসা শুরু করেছে। দেশে উৎপাদিত চিনিগুঁড়া চাল একসঙ্গে বাজার থেকে কিনে মজুদ করে রেখেছে। ফলে সরবরাহ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এতেই এত দাম বেড়েছে।

পাহাড়তলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নেজাম উদ্দিন বলেছেন, ‘চিনিগুঁড়া চাল তো আমদানি হয় না। দেশে যে হারে চাহিদা বেড়েছে, সে হারে উৎপাদন বাড়েনি। আর বছরজুড়েও এই চাল উৎপাদিত হয় না। এই সুযোগে দেশে উৎপাদিত সুগন্ধি চাল কিনে মজুদ করে রেখেছে বড় শিল্প গ্রুপগুলো। বছরজুড়ে তারা এই চাল প্যাকেট করে বিক্রি আর বছরজুড়েই মুনাফা করবে। কারণ বাজারে যখন চাল থাকবে না তখন ওই গ্রুপগুলোর কাছেই আপনি জিম্মি থাকবেন। ভোক্তারা খোলাবাজারে ন্যায্য মূল্যে পোলাউ চাল খাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। ’

সুগন্ধি চালের দাম বাড়ার খবর নিশ্চিত করেছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তবে কী কারণে দাম বাড়ছে, তাঁরা জানেন না। চট্টগ্রাম কাজীর দেউড়ি খুচরা বাজারের হক ভাণ্ডার স্টোরের অন্যতম মালিক মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগে আমরা নবাব ব্র্যান্ডের চিনিগুঁড়া চাল কিনেছি (৫০ কেজি) প্রতি বস্তা চার হাজার ৭০০ টাকা। এখন সেই বস্তা কিনতে হচ্ছে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি বস্তায় ৬০০ টাকা বাড়তি। প্রতি কেজি আগে কিনতে হতো ৯৪ টাকায়, এখন কিনতে হচ্ছে ১০৬ টাকায়। ’

‘বাজারে আমাদের কাছে প্যাকেটজাত চিনিগুঁড়া চালের ক্রেতাই বেশি। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখেই ভোক্তারা এই পোলাউ চাল কেনে। এর বাইরে খোলা চিনিগুঁড়া চাল বিক্রি করছি কেজি ১০০ টাকার ওপরে,’ যোগ করেন মিজান।

এই চিনিগুঁড়া চাল আসল কি না বা আসল হলেও কতটা আসল তা নিয়েও বেশ প্রশ্ন আছে ভোক্তাদের। পোলাউ চাল কিনতে আসা জান্নাতুল মোস্তফা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে পোলাউ চালের কোনো সুগন্ধ পাচ্ছি না। সব চালই নামমাত্র সুগন্ধযুক্ত। ধোয়ার পর আর কোনো সুগন্ধ থাকে না চালে। ফলে বেশি দামে প্যাকেটজাত ব্র্যান্ডেড চাল কিনেও আমরা ঠকছি। ’

ভোক্তাদের কাছ থেকে পাওয়া এমন অভিযোগ খুচরা দোকানির মাধ্যমে পাইকারদের কাছে পৌঁছে। খাতুনগঞ্জের পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরাও বলছেন, চিনিগুঁড়া চাল নামে বাজারে যা বিক্রি হচ্ছে, সেটি কতটা আসল তা নিয়ে আমরাও সন্দিহান। এটা সত্য, এসব চিনিগুঁড়া চালে এখন সুগন্ধ তেমন নেই। উৎপাদিত চালের সঙ্গে একই রকমের অন্য চাল মিশিয়ে প্যাকেট করা হচ্ছে বলে আমাদের ধারণা।

চাল ব্যবসায়ীদের মতে, খোলা চিনিগুঁড়া চালে সুগন্ধ নেই সেটি মানা যায়। কিন্তু বেশি দামে বড় কম্পানির প্যাকেটজাত চালে কেন সুগন্ধ থাকবে না? সেসব কারখানায়ও সাধারণ চালের সঙ্গে চিনিগুঁড়া মিশিয়ে প্রতারণা হয় কি না তদন্ত করতে হবে।

কৃষি দপ্তর বলছে, বাজারে চিনিগুঁড়া নামে যে চাল বিক্রি হয়, তার ৮০ শতাংশই বিআর-৩৪ জাতের। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এই সুগন্ধি চালের জাত উদ্ভাবন করেছে।

চিনিগুঁড়া চালের উৎপাদনের বিপরীতে রপ্তানির পরিমাণ খুবই সামান্য। ফলে এসব চাল যে বড় শিল্প গ্রুগুলোর গুদামে মজুদ আছে, তার প্রমাণ মিলছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন লাখ ৪০ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে সাত লাখ ৬৬ হাজার ৩০৫ মেট্রিক টন সুগন্ধি চাল উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদিত হয় ছয় লাখ ৫৮ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯২ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে সাত লাখ ২৪ হাজার ৫৬১ হেক্টর জমিতে ১৭ লাখ ৭৫ হাজার ১৭৮ মেট্রিক টন সুগন্ধি চাল উৎপাদিত হয়। সে হিসাবে দেশে প্রতিবছর সুগন্ধি ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ছে।

LEAVE A REPLY