সহসাই উত্তরণের সম্ভাবনা নেই : ঢাকায় যানজট ৫ কারণে

রাজধানীর যানজটে অতিষ্ঠ নগরবাসী। ছবি: ভোরের কাগজ

‘গাড়ি চলে না, চলে না, চলে না রে…, গাড়ি চলে না’- প্রয়াত সংগীতশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরীর গাওয়া এই গানটি এখন ঢাকার রাস্তায় বেশ শোনা যায়। যানবাহনের চালক ও হেলপাররাই মূলত হেরে গলায় গানটি বেশি গায়, কখনো কখনো সুর মেলায় যাত্রীরাও। রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা এই গান গাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায়। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা নেই, দিনের যে কোনো সময়ই ১০ মিনিটের রাস্তা পেরুতে লেগে যায় ১ ঘণ্টা, ৩০ মিনিটের রাস্তা যেতেই দেড় ঘণ্টা পার। এই অবস্থা রাজধানীর প্রায় সব সড়কেই। মূলত, ৫ কারণে ভয়াবহ এই যানজটের সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

পরিবহন ও নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিনে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। অনেক কারণ একত্র হয়ে যানজট পরিস্থিতি এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। গণপরিবহন চলাচলে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, রাস্তা ও ফুটপাথ দখল, অপরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণ, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা না থাকা এর অন্যতম কারণ। খুব সহজে এসব সমস্যার সমাধান যেমন সম্ভব না, তেমনি সহজেই যানজট পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা নেই।

যানজট নিয়ন্ত্রণে ডিএমপি কমিশনার থেকে শুরু করে সিটি মেয়র এমনকি মন্ত্রীরাও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। কখনো রিকশা নিয়ন্ত্রণ কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমানো, কখনো ডিজিটাল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আবার কখনো নগর ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়েছে। এসব থেরাপির কিছু কিছু প্রয়োগও করা হয়েছে। তারপরও যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।

নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, গণপরিবহন জনপ্রিয় করতে পারলে রাস্তায় ব্যক্তিগত পরিবহন কমবে। এতে যানজটও কমবে। বাস সার্ভিস আধুনিকায়ন করা না হলে ২০৩৫ সালের মধ্যে সব কটি মেট্রোলাইন চালু হলেও যানজট কমবে না। তখনো ১৭ শতাংশ যাত্রী মেট্রো ব্যবহার করবেন। বাকিদের ভরসা থাকবে বাস। অপরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণ, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা না থাকা এবং সড়কের অনেকটাই দখলে থাকাই যানজটের অন্যতম কারণ। অতীতে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও বাস্তবসম্মত প্রেক্ষাপট অনুযায়ী কখনোই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এই পরিস্থিতি থেকে সহজে উত্তরণের কোনো সুযোগ নেই। যানজট কমাতে হলে পরিকল্পনা নিয়ে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম নিজেও খুব সহজেই ঢাকার যানজট পরিস্থিতি নিরসনের আশ্বাস দিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, একদিনে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। আস্তে আস্তে সমাধানের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ট্রাফিক ব্যবস্থা সিটি করপোরেশনকে দেয়া হলে জোড় এবং বিজোড় গাড়ির নম্বরপ্লেটের ভিত্তিতে রাজধানীর রাস্তায় গাড়ি চালানোর নিয়ম করা হবে। নম্বরপ্লেটে যাদের জোড় সংখ্যা রয়েছে তারা জোড় তারিখের দিনে এবং বিজোড় সংখ্যার গাড়ি বিজোড় তারিখে চালাতে পারবেন। এতে যানজট অনেক কমবে। আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে কাজ না করলে যানজট পরিস্থিতির উত্তরণের সুযোগ নেই।

যানজট পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, এই মূহূর্তে মেট্রোরেলের কাজের কারণে নগরীর বিশাল এলাকার রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এছাড়া ডেসা, ওয়াসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নমূলক কাজের কারণেও গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এর ফলে রাস্তার পূর্ণ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে হিসাব ছাড়াই প্রতিদিন শতাধিক গাড়ি রাস্তায় নামছে। তাছাড়া এবার রোজার মাসেও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। অফিস সময়ের পরিবর্তন হওয়ায় সবাই একসঙ্গে গন্তব্যে পৌঁছতে চায়। এসব কারণ একত্রিত হয়েই যানজট বেড়েছে। পুলিশ যানজট নিরসনে কাজ করে যাচ্ছে।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, বেইলি রোডের সচিবদের আবাসিক ভবন থেকে প্রতিদিন সকালে একসঙ্গে ১১৪ জন সচিব-অতিরিক্ত সচিব গাড়ি নিয়ে বের হন। ১ জনের জন্য একটি গাড়ি। সচিবদের বিশ্বমানের বাস বা মিনিবাসে করে সচিবালয়ে নিয়ে আসা হলে এতো গাড়ি রাস্তায় বের হতো না। এভাবে সাধারণ প্রাইভেট কারে একজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি গাড়ি রাস্তায় বের হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনের রাস্তায় দীর্ঘ লাইনের কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়। গণপরিবহনের আধুনিকায়নে গভীরভাবে ভাবতে হবে। তা না হলে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না।

রাস্তায় দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্টরা বলেন, দিনের শুরুতেই শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীসহ সব পেশার মানুষ একসঙ্গে ঘর থেকে বের হচ্ছে। এসময় সড়কে হাজার হাজার ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ তৈরি হয়। দুপুর থেকে ঈদের কেনাকাটার জন্য লোকজন মার্কেটমুখী হয়। ইফতারের আগে পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকে। সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্যাসের জন্য দিনের লম্বা সময় প্রধান সড়কে গাড়ির লাইন থাকে। উন্নয়ন কাজের কারণে রাস্তার সমস্যাতো আছেই। এসব কারণেই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যার পর কিন্তু এই পরিমাণ যানজট থাকে না। ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমাতে পারলেই সুফল আসবে।

পরিবহন চালক আলম রহমান বলেন, বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের নামে সড়ক অবরোধ হয়, বড় বড় অনুষ্ঠানের নামে সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়, ভিআইপি, ভিভিআইপি প্রটোকলের কারণে ট্রাফিক পুলিশ রাস্তার একদিক আটকে রাখে, রাস্তার ওপর দোকান বসে, পার্কিং করা হয়- এসব কারণেই যানজটের সৃষ্টি হয়।এসআর

LEAVE A REPLY