হাওড়ে ভেসে গেছে ৫৭০ কোটি টাকা

বাঁধ নির্মাণে নিয়ন-কানুন না মানায় হাওড়ের ফসল রক্ষায় পাঁচ বছরে সরকারি বরাদ্দের ৫৭০ কোটি টাকা পানিতে ভেসে গেছে। লুটপাটের কারণে নকশা অনুযায়ী সুনামগঞ্জে কোনো বাঁধেরই কাজ হয়নি। ফলে বাঁধ দুর্বল হয়েছে। এ ধরনের ১৬৮টি বাঁধের ২৩৬ স্থানে ত্রুটি ধরা পড়ে। এসব স্থান থেকে পানি চোয়াচ্ছে। পর্যাপ্ত বরাদ্দ পেয়েও ত্রুটিপূর্ণ বাঁধ নির্মাণের কারণে ১ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমির ধান এবারও ঝুঁকিতে পড়েছে। অথচ কাগজে-কলমে বাঁধের কাজে ৯৮ ভাগ অগ্রগতি দেখানো হয়েছে। যার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার কোনো মিল নেই। এর পেছনে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, প্রভাবশালীদের চাপ এবং অনিয়ম-দুর্নীতির সংশ্লেষ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, ২০১৭ সালে হাওড় বিপর্যয়ের পর ৫ অর্থবছরে ফসল রক্ষায় সরকার ৫৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। প্রতি অর্থবছর ভেঙে ভেঙে এ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু এ অর্থ ব্যয়ে যথাযথভাবে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার হয়নি। বাঁধ ঘিরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নকশা আগাম বন্যা রোধে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেনি। পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৪ অর্থবছরে কোনো বন্যা হয়নি, তাই ফসল তুলতে পেরেছে কৃষক। এখানে বাঁধের কোনো ভূমিকা নেই। এবার আগাম বন্যার কারণে দুর্বল বাঁধের দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসছে। এদিকে কাজের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দা সালমা জাফরিনকে প্রধান করে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি মাঠে কাজ শুরু করেছে।

সূত্র জানায়, বাঁধের কাজের জন্য স্থানীয় জনগণকে নিয়ে ২০১৭ সালের পর পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি) গঠন করা হয়। প্রতিটি বাঁধের জন্য একটি করে পিআইসি গঠন হয়। গত পাঁচ বছর ধরে এই পিআইসির মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কারের কাজ হচ্ছে। তবে সব কমিটি নিয়ম মেনে পরিকল্পনা অনুযায়ী গঠিত হয়নি। অপরিকল্পিতভাবে গঠিত পিআইসি এবারও যেনতেনভাবে মাটির কাজ করে চলে গেছে। এরপর আকস্মিক বন্যা দেখা দেওয়ায় জেলার প্রায় ২শ পিআইসির কাজে বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরা পড়েছে।

প্রসঙ্গগত, স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিআইসির সভাপতি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও (সুপারভিশন অফিসার) সদস্য সচিব। উপজেলায় যে বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কার হয় তার কাজ যথাযথভাবে হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা এই কমিটির দায়িত্ব। নির্মাণ বা সংস্কারের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থও তাদের স্বাক্ষরে ব্যয় হয়ে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ স্থানে এদের অনেকেই রহস্যজনক কারণে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকেন। এ সুযোগে পিআইসি কমিটির সদস্যরা কাজে অনিয়ম করায় দুর্বল বাঁধ নির্মাণ হয়েছে। যা অসময়ে বন্যার পানির চাপ নিতে পারছে না। ভেসে যাচ্ছে একের পর এক হাওড়। ক্ষতি হচ্ছে হাজার হাজার একর জমির ফসল। নকশাবহির্ভূত এই মাটির কাজই এখন গোটা হাওড়াঞ্চলে আতঙ্কের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে জনতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অধিকাংশ স্থানে কোনো নিয়ম মানা হয়নি। ২০১৭ সালের পর গত ৪ বছর (২০১৮, ২০১৯, ২০২০, ও ২০২১) বন্যা হয়নি তাই ফসল পেয়েছে এলাকার কৃষক। এখানে বাঁধের কোনো কৃতিত্ব নেই। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যারা কোনো কাজই বোঝে না তাদের দেয়া হয়েছে বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিআইসি গঠনের প্রক্রিয়াই অনুসরণ হয়নি। যার কোনো জমিই নেই তাদের দেওয়া হয়েছে পিআইসির দায়িত্ব। একমাত্র বোরো ফসলই যে জেলার ভরসা সেখানে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত একটা চেইন থাকা উচিত ছিল। সম্পূর্ণ বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

এই প্রকৌশলী বলেন, আগাম বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে হলে বিআর ২৯ জাতের ধান সম্পূর্ণভাবে বাদ দিতে হবে। এই ধান পাকতে সময় নেয়। ২৯ ধান বেশি হয় এই কারণে কৃষক এটাই রোপণ করেন। আবার ২৮ জাতের ধান যারা রোপণ করেছেন তাদের কাটাও শেষ হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিবেচনায় নিয়ে কৃষকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের গোপন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত জেলার ৭২৭টি পিআইসির মধ্যে ১৬৮টি বাঁধের ২৩৬টি স্থানে ত্রুটি ধরা পড়ে। ত্রুটিপূর্ণ বাঁধের ওসব স্থান থেকে পানি চোয়াচ্ছে। বিপজ্জনক এই ত্রুটিই নকশাবহির্ভূত কাজের ইঙ্গিত দেয়। যা গোটা হাওড়াঞ্চলের জন্য এখন অশনি সংকেত। ইতোমধ্যে পাউবোর জরুরি মেরামত কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তারা ১৭৩টি স্থান মেরামত করেছেন। এছাড়া ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অতিরিক্ত বিশেষজ্ঞ লোকবল এনে সরেজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে বাঁধের ত্রুটি চিহ্নিত করে মেরামতের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে পানি বাড়তে থাকায় স্থানীয় প্রশাসন রাতে কৃষকদের জেগে বাঁধ পাহারা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক শীর্ষ কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, পিআইসি এক্সকেভেটর (দ্রুত মাটি কাটার যন্ত্র) ভাড়া করে বরাদ্দের একটি অংশ দিয়ে মাটি কেটে বাকি টাকাই পকেটে ভরেছে। এই টাকা স্থানীয় প্রশাসন ছাড়াও পিআইসি গঠনে ভূমিকা রাখেন এমন রাজনৈতিক নেতারাও ভাগ পেয়েছেন। পিআইসির চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিবকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বের হয়ে আসবে। আর স্থানীয় প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা যদি পার্সেন্টিজ নিয়ে থাকেন সে বিষয়টিও জানা যাবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, কাজের মান ঠিক রাখতে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন জরুরি। না হলে প্রতিবছরই এমন ঘটনা ঘটবে। স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা বেশ কিছু জায়গায় বাঁধ নির্মাণের কাজ মনিটর করার প্রয়োজনই মনে করেননি। যে কারণে অনেক বাঁধেই ত্রুটি ধরা পড়ছে। তিনি বলেন, ভাগের টাকা নেওয়ার পর তারা কাজ আদায় করেনি। ফলে যেনতেনভাবে কাজ করে চলে গেছেন জড়িতরা। বিষয়গুলো তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখবে বলে আশা করি। কমিটি যদি পাশ কাটিয়ে যায় তবে প্রকৃত চিত্র চাপা পড়ে যাবে, কখনই প্রকাশ হবে না। হাওড়ের এই সমস্যা আর ভবিষ্যতেও সমাধান হবে না।

জেলার দিরাই, ধর্মপাশা ও তাহিরপুরসহ পাঁচটি হাওড়ের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর এই আতঙ্ক সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও পৌঁছেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থেকে শুরু করে শীর্ষ আমলারাও হাওড়াঞ্চল পরিদর্শন করেছেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বারবার হাওড় বিপর্যয়ের পরও সতর্ক হয়নি প্রশাসনের কর্মকর্তারা। অসময়ে পানি বেড়ে ফসলি হাওড় তলিয়ে গেলে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। তখন বাঁধের কাজ তদারকি করতে তৃণমূলে আসেন সবাই। দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের আশ্বাস দেন। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয় না। দিন শেষে দুর্নীতিবাজরাই আরও শক্তিশালী হয়েছে। হাওড় রক্ষা বাঁধে বেড়েছে রাজনৈতিক প্রভাবও। বছরের পর বছর ধরে চলছে এই অবস্থা। এর মধ্যেই সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার হুরামন্দিরা হাওড় ও বৈশাখী বাঁধ ভেঙে চাপতির হাওড়, ধর্মপাশার চন্দ্রসোনার থাল ও তাহিরপুরের গলগলিয়া হাওড়ের বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে অন্তত শত কোটি টাকার ফসল।

দিরাই উপজেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন যুগান্তরকে বলেন, ‘যে তদারকিটা এখন হচ্ছে এটা বাঁধ নির্মাণের শুরুর দিকে দরকার ছিল। তাহলে দুর্নীতি নিয়ে হয়তো এত কথা শুনতে হতো না। আমরা চাই বাঁধের টাকা লুটপাটের প্রকৃত চিত্র যেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে জানানো হয়। তাহলেই এর একটা সমাধান বের হয়ে আসবে।

হাওড় মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী সুনামগঞ্জ জেলায় ৯৫টি, সিলেটে ১০৫টি, মৌলভীবাজারে ৩টি, হবিগঞ্জ জেলায় ১৪টি, নেত্রকোনায় ৩৭টি এবং কিশোরগঞ্জে ৯৭টি হাওড় রয়েছে। পাউবো সুনামগঞ্জ জেলায় ৪৮টি হাওড়সহ অন্যান্য হাওড় ও উপপ্রকল্পের ভাঙন ঠেকাতে মোট ১৭১৮ কিলোমিটার বাঁধ মেরামতসহ পুনর্নির্মাণ করে আসছে। ২০১৭ সালে পিআইসি গঠনের মাধ্যমে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এসব বাঁধ নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নেয়। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে সুনামগঞ্জের ৪৮টি হাওড়কে সুরক্ষিত করতে ৯৬৪টি পিআইসি গঠন করে বাঁধ সংস্কার পুনর্নির্মাণ যাত্রা শুরু হয়। ওই অর্থবছরে ১৫১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বাঁধ সংস্কারের আওতা কমে ৪৫০ কিলোমিটারে নেমে আসে। সে বছর ৫৭২টি পিআইসির জন্য বরাদ্দ হয় ৮০ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৬৩৩ কিলোমিটার বাঁধে ৭৪৫টি পিআইসির জন্য বরাদ্দ হয় ১০২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৬১৯ কিলোমিটার বাঁধে পিআইসি নেয়া ৮১০টি। তখন বরাদ্দ আসে ১০৯ কোটি ৮ লাখ টাকা। এরপর ২০২১-২০২২ অর্থবছরে চলমান এই বাঁধের কাজ কমে ৫৩৬ কিলোমিটারে নেমে এলেও পিআইসির সংখ্যা কমেনি। চলমান এই অর্থবছরে ৭২৭টি পিআইসির অনুকূলে বরাদ্দ চাওয়া হয় ১২২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। তবে কাজের বিনিময়ে এ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট পিআইসিদের পরিশোধ করা হয়েছে ৬৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

LEAVE A REPLY