মাঠ রক্ষায় জনগণ-পুলিশের মুখোমুখি অবস্থান রাষ্ট্রের জন্য অকল্যাণকর

ঢাকার কলাবাগানের উত্তর ধানমন্ডি এলাকার তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। আজ সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটি এ উদ্বেগ প্রকাশ করে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনকর্মী রত্না হোসেন ও তার ছেলেকে পুলিশের আটক ও পরবর্তীতে মুচলেকা প্রদানের মাধ্যমে মুক্তি দেওয়ার ঘটনাসমূহ অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয়। এই মাঠ রক্ষার জন্য স্থানীয় এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের আন্দোলনকে আন্তরিকভাবে আমলে নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে সমাধানের আন্তরিক উদ্যোগ থাকলে এই ঘটনা ঘটত না।

পাশাপাশি তেঁতুলতলা মাঠে থানা না করে অন্য কোনো বিকল্প জায়গা খুঁজে বের করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বানকে স্বাগত জানায় আইপিডি।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলার গুরুত্বের কথা আমরা সবসময়েই বলে থাকি। ঢাকা শহরে দিন দিন শিশু-কিশোরদের বিনোদন এবং খেলাধুলার স্থান সংকুচিত হয়ে আসছে। যে কয়েকটি হাতে গোনা খেলার মাঠ অবশিষ্ট আছে, সেগুলোর অধিকাংশই দখল কিংবা নানাবিধ কারণে খেলার মাঠ হিসেবে আর ব্যবহার করবার সুযোগ নেই। কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠটি কলাবাগান এর শিশু খেলাধুলা করার অন্যতম স্থান। অনেকের জন্যই একমাত্র স্থান ও বটে।

এতে আরো বলা হয়, আদর্শগতভাবে নগর পরিকল্পনায় ২ থেকে ৩ হাজার মানুষের জন্য ন্যূনতম একটা খেলার মাঠ তৈরি করতে হয় যার আয়তন ন্যূনতম এক একর (তিন বিঘা) হওয়ার কথা। আমাদের ঢাকা শহরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি পাড়া-মহল্লায় প্রতি ১২,৫০০ মানুষের জন্য দুই থেকে তিনটি খেলার মাঠ থাকা উচিত যার মোট আয়তন হবার কথা তিন একর। অতি ঘন এলাকা কলাবাগানে আনুমানিক ৩০ হাজারের মতো মানুষের বসবাস করেন। প্রতি ৫ হাজার মানুষের জন্য একটি খেলার মাঠ দেওয়া হলেও এই এলাকায় ৬টি খেলার মাঠ থাকবার কথা, আকার-আয়তনে যা ৬ থেকে ১০ একর হবার কথা।

তেঁতুলতলা মাঠের আয়তন এক বিঘার মতো। ফলে এই স্থানটিও পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী শিশু-কিশোরদের খেলার মতো পর্যাপ্ত নয়। এই খেলার মাঠ রক্ষার আন্দোলন নিয়ে স্থানীয় জনগণ ও আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান রাষ্ট্রের জন্য যেমন কল্যাণকর নয়, তেমনি কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ ও রাষ্ট্রের প্রতি আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলবার পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

এতে আরো বলা হয়, নগর এলাকাসমূহ গড়ে তোলার পরিকল্পনা ও নগরসমূহ বেড়ে উঠবার ক্ষেত্রে উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার মৌলিক দিকসমূহে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। বিদ্যালয়-পার্ক-খেলার মাঠ-থানা প্রভৃতি মৌলিক নাগরিক সেবাসমূহের জন্য ভূমি নির্ধারণ ও সংরক্ষণ ব্যতিরেকে নগর এলাকায় যত্র তত্র বাড়িঘর নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণহীন জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বাড়তে দিয়ে বিশাল সংখ্যক জনমানুষ বসবাসের ক্ষেত্রে এক চরমতর সংকটে পতিত হচ্ছে; পাশাপাশি রাষ্ট্র ও মৌলিক নাগরিক সুবিধা সংস্থান করতে গিয়ে নানাবিধ সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। এই ধরনের অতি ঘন এলাকাতে বসবাসকারী শিশু-কিশোর-বৃদ্ধসহ সকল বয়সের মানুষের হাঁটার জায়গা, খেলার জায়গা ও বিনোদনের জায়গার অভাবে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাহত হবার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যহানি ও অপরাধপ্রবণতার জন্ম দিচ্ছে। ফলে এলাকাভিত্তিক খেলার মাঠ-পার্ক-বিদ্যালয়সহ প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধাসমূহ তৈরি করার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এখনই দরকার।

একইসাথে আইপিডি মনে করে, আধুনিক নগর পরিকল্পনায় খেলার মাঠ-পার্ক-উদ্যানকে স্বাস্থ্য অবকাঠামো বিবেচনা করা হয়, পাশাপাশি এই ধরনের নাগরিক সুবিধাদি সমাজে অপরাধের প্রবণতা ও কমায় বহুলাংশে, ফলে এই ধরনের মাঠকে কেন্দ্র করে যে ধরনের সামাজিক যোগাযোগ ও সামাজিক নিরাপত্তা গড়ে উঠে তার ফলে খেলার মাঠকে শৃংখলা ও নিরাপত্তা অবকাঠামো হিসেবে ও বিবেচনা করা যেতে পারে। আমরা সকলেই জানি, আমাদের নগর এলাকায় সুস্থ বিনোদনের অভাবে শিশু-কিশোরদের অনেকেই মাদকাসক্তি, কিশোর গ্যাং সহ নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে; অনেকেই অবষাদগ্রস্ত ও বিষণ্ন হয়ে পড়ছে। শুধুমাত্র থানা বা জেলখানা নির্মাণের মাধ্যমে এই ভয়ংকর সামাজিক সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে না।

আইপিডি মনে করে, কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠটি এলাকার শিশু-কিশোরদের খেলবার জন্য ভূমি অধিগ্রহণের করার মাধ্যমে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় খেলার মাঠ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। একইসাথে বর্তমানে মাঠের চারপাশে দেয়াল নির্মাণের উদ্যোগ অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। পাশাপাশি এই এলাকায় বিকল্প ভূমি অনুসন্ধানের মাধ্যমে থানা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও নেওয়া একান্তভাবে অত্যাবশ্যক। কোনো অবস্থাতেই স্থানীয় এলাকাবাসী ও পুলিশকে এই মাঠটি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করানো যাবে না, যা আমাদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে অকল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে।

আইপিডি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে, আমাদের সবার স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পাড়ার খেলার মাঠগুলোকে প্রাণবন্ত ও শিশু-কিশোরদের পদচারণায় মুখর করতে হবে। রাষ্ট্র ও সরকার আন্তরিক হলে সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল এলাকায় খেলার মাঠসহ সকল নাগরিক সুবিধাদির প্রয়োজনীয় সংস্থান করা সম্ভব।

LEAVE A REPLY