‘ফিরিয়ে দাও খেলার মাঠ’

খেলার মাঠে থানা ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার জোরালো দাবি জানিয়েছে ১২টি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। সবার সাফ কথা, ‘ফিরিয়ে দাও খেলার মাঠ। সরিয়ে নাও থানা ভবন নির্মাণের সামগ্রী।’ একই সঙ্গে মাঠ রক্ষার প্রতিবাদে সোচ্চার সংস্কৃতিকর্মী সৈয়দা রত্না ও তার ছেলেকে থানা হাজতে ১৩ ঘণ্টা আটকে রাখার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। অধিকারকর্মীরা বলছেন, একজন নাগরিককে বিনা পরোয়ানায় তুলে নিয়ে আটকে রাখা বেআইনি। এটা অগণতান্ত্রিক এবং স্পষ্টভাবে ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার। সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।

‘তেঁতুলতলা মাঠে থানা না, এলাকাবাসীকে হয়রানি ও আটকের তীব্র প্রতিবাদ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন থেকে অন্যতম প্রশ্ন তুলে বলা হয়, কোনো অভিযোগ ছাড়াই একজন নাগরিককে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে কেন?

১২টি এনজিও এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন যৌথভাবে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংগঠনগুলো হলো-এএলআরডি, বাপা, বেলা, আসক, ব্লাস্ট, গ্রিন ভয়েস, নিজেরা করি, নাগরিক উদ্যোগ, নারীপক্ষ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি ও টিআইবি।

এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘তেঁতুলতলা মাঠে থানা ভবন হবে কিনা সে বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ সোমবার রাজধানীর তেজগাঁও সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ঈদবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী আরও বলেন, ‘খেলার মাঠ অবশ্যই প্রয়োজন। তবে থানা ভবনটাও জরুরি। এজন্য ইতোমধ্যে মেয়রকে অন্যত্র বিকল্প জায়গা দেখতে বলা হয়েছে। কলাবাগান থানার কার্যক্রম ভাড়া বাড়িতে চলছে। তাই থানার জন্য ভবন নির্মাণ করতে হবে।’

সৈয়দা রত্না ও তার ছেলেকে থানায় আটকে রাখা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘তিনি ঘটনার যতটুকু জানতে পেরেছেন তা হচ্ছে-লাইভ ভিডিওতে এসে অনেক কিছু প্রচার করা হচ্ছিল। সেগুলো নাকি একটু অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল। বারবার নিবৃত্ত করার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন থামাতে পারেনি তখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে অবশ্য তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’

এদিকে সংবাদ সম্মেলনে বেলার নির্বাহী সভাপতি সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘বসবাসের অযোগ্যের তালিকায় থাকা শহরে একটা খেলার মাঠ নিয়ে নেওয়া মানে আত্মহত্যার শামিল। তাহলে এলাকাবাসী খেলবে কোথায়, কর্তৃপক্ষ এর জবাব কী দেবে?’

রত্নাকে তুলে নিয়ে থানায় আটকে রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আবার দেখলাম। তিনি যদি কোনো আইনভঙ্গ করতেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া যেত। কিন্তু পুলিশ চাইলেই যে কাউকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে পারে? তার ছেলেকেও তুলে নিয়ে গেল।’ তিনি এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান।

সৈয়দা রিজওয়ানা আরও বলেন, ‘দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টা আটকে রেখে রত্নার কাছ থেকে মুচলেকা নিয়েছে পুলিশ। মুচলেকার ভাষাটাও অদ্ভুত। মাঠ রক্ষার আন্দোলন করা যাবে না। কিন্তু কেন? আমরা তো বলি গণতন্ত্র, অথচ আন্দোলন করা যাবে না। তাহলে কী নিয়ে আন্দোলন করা যাবে-তার একটা তালিকা দিয়ে দেওয়া হোক। আসলে এভাবে আটক করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এলাকার অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য।’

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব। এতে বলা হয়, ‘তেঁতুলতলা মাঠটি সংরক্ষণের জন্য নির্মাণকাজ দ্রুত বন্ধ করতে হবে। এছাড়া মাঠটি রক্ষায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও রাজউককে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। পাশাপাশি সৈয়দা রত্না, তার পরিবার এবং আন্দোলনে যুক্ত এলাকাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, সৈয়দা রত্নাকে আটকের মধ্য দিয়ে ১০টি আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা এই অবিচারের প্রতিকার চাই। মাঠ উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানান তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, ‘এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? এই দেশে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার নাই? আইন কি নিজের মতো চলে না?’ মানুষ প্রশ্ন করবে, জবাব চাইবে। একজন নাগরিকের কী কী অধিকার সুরক্ষার জন্য কী কী ব্যবস্থা আছে-এসব কথা বলতে হবে।’

বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘শহরের মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। ধানমন্ডির শেখ জামাল মাঠটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা। কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষ ঢুকতেও পারে না। এর জবাব কে দেবে।’

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহসভাপতি মাহমুদ সেলিম, সহসাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটন, ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এসএম রেজাউল করিম প্রমুখ।

এদিকে সংবাদ সম্মেলন শেষে দুপুরে তেঁতুলতলা মাঠে নাগরিক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা ছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দারা বক্তব্য রাখেন। আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে উচ্চ আদালতের আইনজীবী ও ক্রীড়া সংগঠক ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, ‘উনি সরকারি কাজে কোনো বাধাও দেননি। তাকে ধরে থানায় নিয়ে গেছে। তারপরও একটা শিশুকে ধরে নিয়ে হাজতে ঢুকিয়ে রাখা হলো। এর ছবিও আছে। এর মানে কী? পুলিশ কি কোনো আইনের আওতায় নেই।’

একজন স্থানীয় বাসিন্দা কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাঠ রক্ষার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘এখানে তার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই মাঠজুড়ে তার স্বামীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে তাকে গোসল করানো হয়েছে। এ জায়গাটায় তার লাশ রাখা হয়। সুতরাং এই স্মৃতিটুকু বিলীন করে দেবেন না দয়া করে।’

মাঠ রক্ষার প্রতিবাদে সোচ্চার উদীচী কর্মী সৈয়দা রত্ন অসুস্থ থাকায় সমাবেশে আসতে পারেননি। তবে তার মেয়ে শেউঁতি শাহগুফতা উপস্থিত ছিলেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘মাঠে নির্মাণকাজ এখনই বন্ধ রাখা হোক। কিন্তু যদি এমন হয় যে, জায়গার খোঁজও চলছে আবার এখানে নির্মাণকাজ চলতে থাকল। এটা প্রহসনমূলক বিচার হবে। কিন্তু এখন এমনও যদি হয়, জায়গার খোঁজ চলছে তাহলে এখন অন্তত নির্মাণকাজ বন্ধ থাকুক। তাতেও আমরা খুশি থাকব।’

নাগরিক সমাবেশ চলাকালে মাঠ রক্ষার দাবি সংবলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করা হয়। এ সময় ‘মাঠ চাই, মাঠ চাই, ফিরিয়ে দাও আমাদের মাঠ’-বলে স্লোগান দেয় শিশু-কিশোররা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, তেঁতুলতলা মাঠে থানা ভবন নির্মাণের বিষয়টি সামনে আসে ২০২০ সালের আগস্টে। সে সময় ঢাকা জেলা প্রশাসনের এক নোটিশে জমিকে পতিত হিসাবে দেখানো হয়। এরপর কলাবাগান থানার নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণের প্রস্তাবের কথা জানায় জেলা প্রশাসন। এ সংক্রান্ত নোটিশের পর থেকেই স্থানীয়রা জায়গাটিকে মাঠ হিসাবে রাখার দাবি জানিয়ে আসছেন। এর মধ্যে গত ৩১ জানুয়ারি তেঁতুলতলা মাঠে খেলতে যাওয়া কয়েক শিশুর কান ধরে ওঠবস করায় পুলিশ। এ সংক্রান্ত ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।

এদিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সোমবার রাতে জানা যায়, মঙ্গলবার যদি ফের নির্মাণকাজ শুরু হয় তাহলে উল্লেখিত সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে নতুন করে কর্মসূচি দেওয়া হবে।

LEAVE A REPLY