হঠাৎ ‘উধাও’ সয়াবিন তেল

দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা যখন ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে কেনাকাটায় ব্যস্ত তখনই বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল সয়াবিন তেল।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী, বনানী, তেজকুনীপাড়াসহ বড় বড় কাঁচাবাজারের মুদি দোকানগুলোতেও এ ভোজ্যতেলের দেখা মিলছে না।

দুএকটি দোকানে পাওয়া গেলেও চাহিদার তুলনায় তা একেবারেই অপ্রতুল।

শুধু রাজধানীই নয়; মফস্বলের বাজারগুলোতেও রাতারাতি উধাও সয়াবিন তেল!

ঈদের আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ তেল বাজারে না পেয়ে অনেকেই দিশেহারা, মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন – ঈদে কীভাবে মেহমানদারী করবেন? 

খুচরা দোকানিরা বলছেন, পাইকারী বা আড়তদাররা বলছেন, তাদের কাছে সয়াবিন তেল নেই। পাইকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোম্পানিগুলো থেকে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে না। তাই এই সংকট।

যদিও ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা দাবি করছেন, তারা আগের মতই সরবরাহ করছেন। মাঝপথে কোথাও ‘গরবড়’ হচ্ছে।

একটি প্রসিদ্ধ সয়াবিন তেল প্রস্তুতকারক কম্পানির পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা দাবি করেন, চাহিদা অনুযায়ী তারা সরবরাহ করছেন। তাদের দিক থেকে কোনো ঝামেলা নেই। 

অন্য আরেকটি ব্র্যান্ডের তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি অ্যাডভাইজার শফিউর রহমান বলেন, মিল থেকে সয়াবিন ও পাম তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। এর পরেও কোথায় কী কারণে তেলের সঙ্কট হচ্ছে আমরা বুঝতে পারছি না। 

বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্টদের উপর ছেড়ে দেন তিনি। 

প্রশ্ন হচ্ছে – এ ‘গরবড়’টা লাগলো কোথায়? তবে কি ফের মজুতদার সিন্ডিকেটের কবলে দেশ?

ঢাকার বনানীর এক মুদি দোকানি বললেন, গত দুইদিন ধরে সয়াবিন তেল কিনতে পারছি না। ফলে বিক্রি বন্ধ রয়েছে। সয়াবিন না পেয়ে কেউ কেউ রাইস ব্রান তেল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। 

কারওয়ান বাজারে রাকিব ও  আলী স্টোরের দুই দোকানি বললেন, গত এক সপ্তাহ ধরে বোতলজাত সয়াবিন তেলেরসরবরাহ সঙ্কট চলছে। ডিলাররা তেল দিচ্ছে না তাদের। তাই তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। 

মহসিন ইসলাম নামের এক দোকানি বলেন, প্রতি ড্রাম ৩৭ হাজার টাকা করে কিনে খোলা সয়াবিন তেল কিনেছিলাম কয়েকদিন আগে। চাহিদার তুলনায় মজুত কম বিধায় কিছু পরিচিত ক্রেতার কাছে তেল বিক্রি করছেন এ দুদিন। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের ক্রয়মূল্য ১৮১ টাকা ও পাম তেলের ক্রয় মূল্য ১৭১ টাকা করে পড়েছে তার।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য স্থানের চিত্রও প্রায়ই একই রকম। প্রায় জায়গাতেই গত দুইদিনে তেল মিলছে না।

চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় এলাকার এক দোকানি জানালেন, ১৫ দিন ধরে কোনো কোম্পানির ডিলারের প্রতিনিধি আসেনি। যোগাযোগ করলে তাদের বলা হচ্ছে, ঈদের পরে দাম বাড়ানো হবে বলে কোম্পানি যেমন তেল ছাড়ছে না, তেমনি কোথাও কোথাও মুজদ করা হচ্ছে।

উদ্ধুত পরিস্থিতিতে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তাতেই ‘গরবড়’-এর একটা বড় রহস্যজট খুলল।

বোঝা গেল, ঈদের পর দাম বাড়বে শুনে অসাধু ব্যবসায়ীরা তেল মজুত করেছেন।

অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ফাহমিনা আক্তারের নেতৃত্বে রোববার বেলা ১১টার পর কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটে অভিযান চালানো হয়। 

মার্কেটের তিনতলায় ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের এক গুদাম খুলতেই বেরিয়ে আসে কার্টনভরা সয়াবিন তেল। সেই তেল নিচতলার মুদিদোকানিদের কাছে বিক্রি করা হয়। আর সয়াবিন তেল মজুত করায় তিন ব্যবসায়ীকে ২ লাখ ১০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়।

বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোর নামের তেলের এক ডিলারের গুদামে ৫ লিটারের ১০০ কার্টন বা ৪০০ বোতল (মোট ২ হাজার লিটার) সয়াবিন তেল পান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। 

চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে সয়াবিন তেল পরিশোধনকারী কোম্পানি থেকে পর্যাপ্ত তেল সরবরাহ করা হচ্ছে জানিয়ে ফাহমিনা আক্তার বলেন, ‘আমরা খুচরা ও পাইকারি বাজারের পাশাপাশি সয়াবিন তেল পরিশোধনকারী কোম্পানির মিলগেটেও তদারকি করছি। সেখান থেকে প্রতিদিন রেকর্ড পরিমাণ তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। বোতলের গায়ে উল্লেখ করা দামের চেয়ে কেউ এক টাকা বেশি দামে বিক্রি করলে জরিমানা করা হবে। বেশি দামে তেল বিক্রি করতে দেখলে ভোক্তাদের অধিদপ্তরের হটলাইনে (১৬১২১ নম্বরে) অভিযোগ করুন।

উল্লেখ্য, চলতি বছরে ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর সময়েও দেশের অনেক এলাকার অনেক দোকানে তেল পাওয়া যায়নি। মার্চের প্রথমে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কথা বলে দেশে ভোজ্যতেলের দাম সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অন্তত ৪০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কোথাও কোথাও খোলা সয়াবিনের দাম ২০০ টাকাও নেওয়া হয়। 

পরে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার পাশাপাশি দামও কমে আসে।  মার্চের ওই সময়ে সরকার ভোজ্যতেলের ওপর থেকে ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহারের পর দামেও সমন্বয় করে। নতুন দরে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৪০ টাকা এবং পাম তেল ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।


প্রসঙ্গত, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৮০ শতাংশের বেশি আমদানি করে পূরণ করা হয়। সাত থেকে আটটি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত তেল আমদানি করে পরিশোধন করে বাজারে ছাড়ে। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, এ বছর মার্চ ও এপ্রিল দুই মাসে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৯২ হাজার টন, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সময়ে (১ মার্চ-২৮ এপ্রিল) ১ লাখ ৩৭ হাজার টন সয়াবিন তেল বন্দরের কাস্টম বন্ডেড ট্যাংক টার্মিনাল থেকে খালাস করেছে কোম্পানিগুলো।

LEAVE A REPLY