মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখা বড় চ্যালেঞ্জ > আমদানি ব্যয় কমিয়ে সুরক্ষিত রাখতে হবে রিজার্ভ
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বড় সংকটের মুখে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। এই পরিস্থিতিতে দেশে বিভিন্ন পণ্যের দাম মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। যে কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় বেড়ে গেছে আমদানি ব্যয়ও। চাপ বাড়ছে বৈদেশিক রিজার্ভে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, সব মিলিয়ে কোভিড পরবর্তী অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও এবার বড় চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়তে হচ্ছে সরকারকে। আর এই সংকট সহসাই কাটবে বলেও মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। আমদানি ব্যয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে বলেও মনে করে পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ইতোমধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়ে গেছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এতে চাপ বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও। আর পণ্যের দাম বেশি বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে গেছে সার্বিক মূল্যস্ফীতি। এই যুদ্ধ শুরুর পরই টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করেছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার ছেড়ে টাকার মান ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। এতে রিজার্ভ কমে যাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে মনে করেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, রিজার্ভ সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়লেও তাই করা উচিত। কারণ ইতোমধ্যে প্রতিটি দেশ তাদের বৈদেশিক রিজার্ভে জোর দিচ্ছে। সব মিলে অর্থনীতিতে আরো গভীর সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলেও অভিমত তাদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। ইতোমধ্যে ডলারের
দাম বেড়ে গেছে। যার কারণে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলার ছেড়ে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে। ফরমাল মার্কেটে ডলারের দাম সাড়ে ৮৬ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। আর ইনফরমাল মার্কেটে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯২ টাকা দরে। এর প্রভাব পড়বে রেমিট্যান্সে। এসব কারণে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আহরণ কমে যাবে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঞ্চিতি ধরে রাখা। এছাড়া ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ব্যয়ও বাড়ছে। সব মিলে আগামী বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণও বেড়ে যাবে বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যুদ্ধের প্রভাব সাপ্লাই চেইনে পড়ার কারণে তেল, গ্যাস থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। সহসাই এই সংকটের সমাধান হবে না। কারণ হিসেবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সহসাই এই যুদ্ধ পরিস্থিতি উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই। রাশিয়া যদি এই যুদ্ধের পরিধি আরো বাড়ায়, তাহলে সংকট আরো বেশি প্রকট আকার ধারণ করবে। তবে রাশিয়া নতুন করে যুদ্ধের পরিধি বাড়াবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না। আর শিগগির যুদ্ধও শেষ হচ্ছে না। তাই এই অর্থনৈতিক সংকট আরো দীর্ঘায়িত হবে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত বৈদেশিক রিজার্ভের স্থিতি আরো বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা। এক্ষেত্রে কিছু কিছু পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করলেও সরকারের বৈদেশিক রিজার্ভের চাপ কিছুটা কমবে বলে মনে করেন তিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি থেকে শুরু বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এছাড়া পণ্য পরিবহন ব্যয়ও অনেক বেড়ে গেছে। টাকা অবমূল্যায়িত হওয়ারও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব কারণে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ছোট হয়ে আসবে প্রবৃদ্ধি। শুধু বাংলাদেশ নয়; উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি অনেক কমে যাবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোভিড পরবর্তী অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে ধরনের পূর্ভাবাস ছিল তা হয়তো হবে না। এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে জ্বালানি তেলসহ সবকিছুর দাম হু হু করে বাড়ছে। এছাড়া যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে গেছে। আমদানি ব্যয় বাড়ায় রিজার্ভের সঞ্চিতি কমছে।
এদিকে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে বেড়ে গেছে মূল্যস্ফীতিও। সব মিলে অর্থনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- শিগগিরই এই সংকট কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। আর এই চাপ সামলাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- অর্থনৈতিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে আগামী বাজেটে কি পরিমাণে ভর্তুকি রাখবে সরকার, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে।এসআর