ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা! মশা নিধনে মাঠে দুই মেয়র

প্রতীকী ছবি

বর্ষা মৌসুম পুরোপুরি শুরু না হতেই রাজধানীতে বেড়েছে এডিস মশার প্রকোপ। ফলে গত বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে- এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। তাইতো মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের নানা প্রক্রিয়া নিয়ে মাঠঘাট চষে বেড়াচ্ছেন তারা। এ কাজে নগরবাসীকে পাশে থাকারও জোর আহ্বান জানানো হচ্ছে।

সম্প্রতি ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২২টি ওয়ার্ডকে ডেঙ্গুর জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে একটি জরিপ প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এমন পরিস্থিতিতে বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এখনই ডেঙ্গু প্রতিরোধে জোর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিচ্ছেন কীটতত্ত্ববিদরা। তারা বলছেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে করোনার মতো ডেঙ্গুও প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে।
গবেষণা নির্ভর দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প ছাড়া ডেঙ্গু নির্মূল সম্ভব নয় বলে অভিমত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশারের। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, প্রতি বছর মৌসুমের শুরুতে এসে উদ্যোগ নিয়ে কোনো লাভ হবে না। ডেঙ্গু নির্মূলে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। বর্ষা শুরুর আগেই সিটি মেয়রদের উচিত কাউন্সিলরদের নিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে, পাড়া-মহল্লায় ভাগ করে স্থানীয় সমাজকর্মী এবং যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা।

বিগত বছরগুলোতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের পর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নানা প্রকল্প, উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। এজন্য কলকাতা ও সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতাও নিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে আলাদা বিভাগ চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও তার সিংহভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। তবে এ বছর দুই সিটি করপোরেশন মশক নিধন কাজে বেশ গুরুত্ব দিয়েছে। বাড়িয়েছে এ খাতের বরাদ্দও। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বছর শুরুর আগে থেকেই উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামকে মাঠে বেশ তৎপর দেখা গেছে। তবে এ কাজে ওই সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রের তেমন কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি নগরবাসীর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সার্ভে কী বলছে : রাজধানীর দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডের ১১০ স্থানে ডেঙ্গুর প্রকৃত অবস্থা নিয়ে মাঠপর্যায়ে চালানো প্রাক-মৌসুম এডিস সার্ভেতে এ আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা পরিচালিত এ জরিপে উত্তর সিটির ৬৩টি এবং দক্ষিণ সিটির ৯৬টি বাড়িতে এডিস মশা অতিরিক্ত মাত্রায় চিহ্নিত করা হয়েছে। জরিপে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ২২টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন মাত্রার ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় ৯৪ দশমিক ৯ শতাংশ কিউলেক্স মশা আর বাকি ৫ দশমিক ১ শতাংশ এডিস মশা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে নির্মাণাধীন ভবনে, যা ৪২ দশমিক ১১ শতাংশ, বহুতল ভবনে ৩১ দশমিক ৫৮ শতাংশ, একক ভবনে ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ, সেমিপাকা/বস্তি এলাকায় ৯ দশমিক এবং পরিত্যক্ত (ফাঁকা) জমিতে ১ দশমিক ১৭ শতাংশ মশার লার্ভার সন্ধান মিলেছে।

মধ্যম মাত্রার ডেঙ্গু ঝুঁঁকিতে থাকা ডিএসসিসির ওয়ার্ডগুলো হলো- রাজারবাগ ও চামেলীবাগ এলাকা নিয়ে গঠিত ১৩ নম্বর ওয়ার্ড; ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা এবং পূর্ব রায়েরবাজার নিয়ে গঠিত ১৫ নম্বর ওয়ার্ড; শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলা মোটর এলাকা নিয়ে গঠিত ২১ নম্বর এবং লালবাগ ও আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত ২৩ নম্বর ওয়ার্ড। মধ্যম মাত্রার ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে থাকা ডিএনসিসির ওয়ার্ডগুলো হলো- পল্লবী ও আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত ৬ নম্বর ওয়ার্ড, মহাখালী ও আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত ২০ নম্বর ওয়ার্ড এবং লালমাটিয়া ও মোহাম্মদপুর এলাকা নিয়ে গঠিত ৩২ নম্বর ওয়ার্ড। ব্রুটো ইনডেক্স অনুযায়ী, এসব এলাকায় মশার ঘনত্ব ১০ থেকে ১৯ শতাংশ। এছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো ডিএসসিসির- ৮, ১৪, ২০, ৩৫, ৪৬ ও ৫১ নম্বর ওয়ার্ড এবং ডিএনসিসির- ১০, ১৩, ১৬, ২৭, ৩০ ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড।
তবে শঙ্কা যেমনটাই হোক প্রতিরোধে প্রস্তুতির ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, লোকবল, যন্ত্রপাতি এবং ওষুধ কী পরিমাণ মজুত আছে সেগুলো নিয়ে দুই সিটির মেয়রের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের অবস্থাটা পর্যালোচনা করেছি। ডেঙ্গু মোকাবিলায় তারা পুরোপুরি প্রস্তুত আছে।

নিয়ন্ত্রণে কতটা প্রস্তুত দুই সিটি করপোরেশন : ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, দুই ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে করপোরেশনগুলো। প্রথমত বছরব্যাপী, দ্বিতীয়ত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনাটি যাচাইবাছাই চলছে। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয় ও মেয়রের নেতৃত্বে ৩টি সভা হয়েছে। সেখান থেকে এ ব্যাপারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে খাল ও জলাশয় পরিষ্কার করার কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। এছাড়াও এলাকা ধরে পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন সকাল-বিকাল ৪ ঘণ্টা করে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। ‘পাশাপাশি বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান বা চিরুনি অভিযানও পরিচালনা করা হচ্ছে। জনসচেতনতা কর্মসূচির ওপর সর্বোচ্চ জোর দিয়ে পথসভা, লিফলেট বিতরণ, মাইকিং করা হচ্ছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে। বাড়ানো হয়েছে বরাদ্দ, যান, যন্ত্রপাতি ও কর্মী বাহিনী।

এডিস মশা নির্মূলে উত্তর সিটি করপোরেশন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মার্ক করা ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোতে অভিযান শুরু করেছে। ডিএনসিসি এলাকায় ১০ দিনের মশা (ডেঙ্গু ও এডিস) নিধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র আতিক। ১৭ থেকে ২৬ মে পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে। অভিযান চলাকালীন দশ দিন মশক বিভাগের সব ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এছাড়াও যেসব এলাকায় মশার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে, সেসব এলাকার ড্রেন-জলাশয়ে আবারো গাপ্পি মাছ ছাড়া হবে। এর আগেও এমন উদ্যোগ নিয়েছিল দুই সিটি কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে ডিএনসিসির মেয়র ভোরের কাগজকে বলেন, ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে বছর শুরুর আগে থেকেই কাজ শুরু করেছি। আমরা যে তথ্য পেয়েছি গত বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গু আরো বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে। তবে আমরা সাধ্যমতো সবাইকে নিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করব। প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে গিয়ে ক্যাম্পেইন করা হবে। ডিএনসিসির এরিয়ার সমস্ত ওয়ার্ডে আমাদের এই চিরুনি অভিযান পরিচালিত হবে। এই অভিযান শেষে আমি নিজেই এবার অভিযানে নামব।

অন্যদিকে ডেঙ্গু ঠেকাতে মাঠে নেমেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসির) মেয়র ফজলে নূর তাপসও। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো ধরে এডিস নিয়ন্ত্রণে বিশেষ চিরুনি অভিযানের কার্যক্রম শেষ করেছেন তিনি। এ ব্যাপারে মেয়র তাপস বলেন, দুটি বিষয়কে বিবেচনা করেই আমরা এবার আগাম কাজ শুরু করেছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বর্ষা মৌসুমের আগেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রাক-মৌসুমের একটি জরিপ করা হয়েছে। সেখানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩টি ওয়ার্ডকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৪টি ওয়ার্ডকে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা এই ৭টি ওয়ার্ডকে নিয়েই কাজ করেছি, যাতে কোথাও লার্ভা জমে না থাকতে পারে।

আগামী আষাঢ় মাস থেকে মূল অভিযান পরিচালনা করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা সরকারের কাছে ১০টি অঞ্চলের জন্য ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছি। যাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারি। এছাড়া চলতি মাসের ১৬ তারিখে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা করব। এর মাধ্যমে আমরা আরো জনসচেতনতা বাড়াতে চাই।

ডেঙ্গুর বর্তমান অবস্থা : গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে জানানো হয়, দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট আটজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ছয়জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি দুজন। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত হাসপাতালে সর্বমোট রোগী ভর্তি ছিলেন ১৮৮ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়েন ১৮১ জন। এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যুর খবর নেই।

যা বলছে স্বাস্থ্য বিভাগ : ডেঙ্গুর ভয়বহতার শঙ্কার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণেও পরিকল্পনা মাফিক প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে দুই সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ। উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, আলাদা করে নির্মাণাধীন ভবন এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থান তদারকি করছি। এছাড়াও খুব কম সময়ের মধ্যে আমাদের সব খালে গাপ্পি মাছ ছাড়ার কাজ শেষ হবে, এতে মশার লার্ভা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। অন্যদিকে দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। দ্বিগুণ জনবল নিয়ে আমরা এবার কাজ করব।এসআর

LEAVE A REPLY