দেশের একটি বাণিজ্যক ব্যাংক ও পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রশান্ত কুমার হালদার বা পিকে হালদার প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকে জব্দ করা হিসাবে আছে ১৪০০ কোটি টাকা। এছাড়া সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার করেছেন। বাকি টাকা স্থানান্তর করেছেন বিভিন্ন ব্যক্তির হিসাবে।
এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস থেকে ৫০০ কোটি টাকা। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) থেকে ৫১০ কোটি টাকা। রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ৪০০ কোটি এবং নতুন প্রজন্মের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
আলোচ্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) পরিচালিত আলাদা তদন্ত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, পিকে হালদারের আত্মসাৎ করা অর্থের মধ্যে তার সহযোগীদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা জমার সন্ধান পাওয়া গেছে। এর বাইরে আরও কিছু অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে যা প্রভাবশালীরা ভাগ-ভাটোয়ারা করে নিয়েছেন। এর মধ্যে বেশকিছু টাকা বিদেশে পাচারের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাকি টাকার কোনো সন্ধান মিলছে না।
ধারণা করা হচ্ছে, এসব টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়েছে। এই বেআইনি কাজে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সাবেক ডেপুটি গভর্নর, এক নির্বাহী পরিচালকসহ কয়েক কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে।
পিকে হালদার প্রথমে ছিলেন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। পরে তিনি নতুন প্রজন্মের ব্যাংক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি হন। ব্যাংকের এমডি থাকা অবস্থায়ই তিনি আর্থিক খাতে জালিয়াতি শুরু করেন। আর্থিক খাত থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পিকে হালদার দেশ থেকে পালিয়ে যান। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর শনিবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পরই পিকে হালদার নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠা করেন ভুয়া কোম্পানি। এগুলোর নামে শেয়ার কিনে একে একে ৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন। এসব প্রতিষ্ঠানের পর্ষদে ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেন নিজের আত্মীয়-স্বজন বা অনুগত ব্যক্তিদের।
এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে তিনি নিয়ন্ত্রণ নেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) বেশিরভাগ শেয়ার। এরপর কাগুজে কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন। এ প্রতিষ্ঠানটি এখন আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
একই প্রক্রিয়ায় তিনি এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখান থেকে প্রায় ১১১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানটিও এখন আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডও তিনি একই প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণে নেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে ১১৩১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে পিকে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নামেই নেওয়া হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে ৫১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ অর্থও পরিচালকরা হাতিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যে পিকে হালদারের মালিকানাও রয়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠানটির অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
এদিকে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি থাকার সময়ে পিকে হালদার নামে-বেনামে ঋণ দিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে নিজ প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউজকে দিয়েছেন ৪০০ কোটি টাকা। এসব টাকায় তিনি নামে-বেনামে শেয়ার কিনে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে নিজেদের লোকদের বসিয়েছেন।
এর মধ্যে শুধু ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) থেকে নামে-বেনামে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ওই অর্থের মধ্যেই শুধু ১১০০ কোটি টাকা এফডিআর হিসাবে দেশে রয়েছে। বাকি প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার ও বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। তবে এসব অর্থের বড় অংশেরই সুবিধাভোগী পিকে হালদার ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় ছিলেন পিকে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার ও স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারীসহ বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন।
পিকে হালদার ও তার ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে একটি কোম্পানি খোলেন ২০১৮ সালে। যার অন্যতম পরিচালক পিকে হালদারের ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার। কলকাতার মহাজাতি সদনে তাদের কার্যালয়। এটি একটি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি।
কানাডায় পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কোম্পানি খোলা হয় ২০১৪ সালে। এর মালিকানায় রয়েছেন পিকে হালদার, প্রিতিশ কুমার হালদার ও স্ত্রী সুস্মিতা সাহা। এটি একটি হাউজিং কোম্পানি। সে দেশে কোম্পানিটি হাউজিং ব্যবসা করছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। কানাডায় তাদের একটি বাড়িরও সন্ধান পাওয়া গেছে।
পিকে হালদারের মা লীলাবতীর তিনটি ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে টাকা স্থানান্তরের তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু পরে ওই হিসাব থেকে টাকা কোথায় গেছে সে তথ্য মিলছে না। ফলে তার হিসাব থেকে ১৫০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দেশ থেকে পাচার করা টাকায় পিকে হালদার ও তার সহযোগীরা বিদেশে ব্যবসা করছেন। এর মধ্যে ভারত ও কানাডায় তাদের নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার তথ্য পাওয়া গেছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করছেন বলেও জানা গেছে।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি থাকার সময় দেশে বা বিদেশে নিজ নামে কোনো কোম্পানি প্রতিষ্ঠার সুযোগ নেই। এ ধরনের কোম্পানি গঠন করলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে। একই সঙ্গে অনুমোদন নিতে হবে। পিকে হালদার তার কোনোটিই করেননি।