শিবশংকর নামে কলকাতায় আত্মগোপনে ছিলেন পি কে হালদার

    শনিবার ভারতীয় গোয়েন্দারা পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করে। ফাইল ছবি

    এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার ভারতে জালিয়াতি করে নিজের নাম পরিবর্তন করে নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস করছিলেন। তিনি নিজেকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে জাহির করছিলেন। পি কে হালদারের অন্য সহযোগীদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী ডিরেক্টরেট অব এনফোর্সমেন্ট (ইডি) এসব তথ্য জানিয়েছে।

    শনিবার সংস্থাটির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পিকে হালদার সে দেশে শিবশঙ্কর হালদার নাম ধারণ করেছিলেন। এই নামে তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে রেশন কার্ড করে নেন। এমনকি ভারতীয় ভোটার কার্ড, প্যান ও আধার কার্ডের মতো বিভিন্ন সরকারি পরিচয় জালিয়াতি করে তিনি নিজেকে শিবশঙ্কর হালদার বানিয়ে নেন।

    এ পরিচয়পত্রের সাহায্যে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু সংস্থা (কোম্পানি) তারা খুলেছিলেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় জমিজমাও কিনেছিলেন। কলকাতার কিছু অভিজাত এলাকাতেও তাদের বেশ কিছু বাড়ি রয়েছে। এসবই ইডি তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে।

    পি কে হালদার বাংলাদেশে বহু কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত বলেও ইডি তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে। তারা বলেছে, এই টাকা বিরাট পরিমাণে ভারতসহ অন্যান্য দেশে ঢোকানো হয়েছে।

    শনিবার সকালে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে ইডি। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও দুদকের অনুরোধে ভারতে এ অভিযান চালানো হয়। এসময় তারা আরও পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। এরমধ্যে দুইজন বাংলাদেশি। তারা হলেন, প্রীতিশ কুমার হালদার ও প্রাণেশ কুমার হালদার। এছাড়া উত্তম মিত্র, স্বপন মিত্র ও সঞ্জীব হাওলাদার নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

    এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন প্রশান্ত কুমার হালদার। তার বিরুদ্ধে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। শনিবার (১৪ মে) ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পিকে হালদারকে গ্রেফতার করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)।

    পিকে সিন্ডিকেটের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দুদক অদ্যাবধি ২২টি মামলা করেছে। আরও ১৩টি মামলা অনুমোদনের অপেক্ষায়। মামলাগুলোতে ২ হাজার কোটি টাকার ওপর আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। অদ্যাবধি এসব মামলায় ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

    দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব মামলায় আদালত ৬৯ জনকে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এ ছাড়া ২০২১ সালের অক্টোবরে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় আদালতে চার্জশিটও দেয়া হয়েছে।

    আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুসহ সিন্ডিকেটের সহায়তায় কয়েকটি লিজিং কোম্পানি থেকে অন্তত ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা সরিয়ে পিকে হালদার দেশ থেকে সটকে পড়েন। এ অর্থের বড় একটি অংশ কানাডা, ভারত ও সিঙ্গাপুর পাচার করেন।

    বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা সরানো হয়। এ ছাড়া এফএএস ফাইন্যান্স, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পিপলস লিজিং থেকে একই কায়দায় আরও প্রায় ৭৫০০ কোটি টাকা ঋণের নামে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে পিকে হালদার ও তার সিন্ডিকেট।

    পিকে হালদারের জন্ম পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার দিঘিরজান গ্রামে। বাবা প্রয়াত প্রণনেন্দু হালদার ও মা লীলাবতী হালদার। তার মা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন।

    ২০১০ সালে পিকে হালদার যখন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি ছিলেন তখন রাশেদুল হক রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ডিএমডি ছিলেন। পিকে হালদার যখন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন, রাশেদুল হক তখন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি হিসেবে ২০১৫ সালে যোগদান করেন।

    এমডি হিসেবে যোগদান করেই পিকে হালদার সব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেন। যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ প্রস্তাবের পরদিনই ঋণ দিয়ে দেন। এভাবে প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠানকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেন। কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে দুর্নীতি, জালিয়াতি ও নানাবিধ অনিয়মের মাধ্যমে ঋণের নামে লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্যাপিটাল মার্কেটে সরিয়ে নিয়ে এসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

    পিকে হালাদারের অপকর্মের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বড় একটি সিন্ডিকেট ছিল। পিকে হালদারের অপকর্মের সঙ্গে ছিল তার কয়েকজন বান্ধবীও। পিকে হালদারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর নাম নাহিদা রুনাই। এই বান্ধবী পিকের অন্যতম সহযোগীও।

    পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবে পরিচিত নাহিদা রুনাইয়ে বাড়ি চট্টগ্রামের খুলশী থানার পূর্ব নাসিরাবাদ এলাকায়। নাহিদা রুনাই ঢাকায় এসে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডে চাকরি পান। চাকরির সুবাদে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় পিকে হালদারের সঙ্গে।

    ২০০৯ সাল থেকে রিলায়েন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন পিকে হালদার। ২০১২ সালের দিকে পিকের সঙ্গে পরিচয় রুনাইয়ের। পিকে হালদারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এত বেশি হয়ে যায় যে, তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এসএমই লোন শাখার অফিস এক্সিকিউটিভ থেকে প্রতিষ্ঠানপ্রধান পিকে হালদারের বান্ধবী ‘বড় আপা’ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। পদ পেয়ে হয়ে যান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট।

    পিকে হালদারের আরেক বান্ধবী সুভ্রা রানী ঘোষ। দুজনই গ্রেফতার হয়ে এখন কারাবন্দি। যদিও গ্রেফতার হওয়ার পর দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তারা একে অপরকে প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করেন।

    তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নাহিদা রুনাই ও ওকায়ামা লিমিটেডের পরিচালক সুভ্রা রানী ঘোষ। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পিকে হালদারের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে। তারা জালজালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের ঋণ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন।

    পিকে হালদার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইএলএফএসএলেরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে ২০২১ সালের শুরুতেই তিনি বিদেশে পালিয়ে যান।

    LEAVE A REPLY