জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড় বছরের বেশি সময় বাকি থাকায় নির্বাচনের আগের বছর বাজেটে ভোটার তুষ্টির জন্য নানামুখী প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। ছবি: ভোরের কাগজ
আসছে বাজেট। প্রস্তুতি চলছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেরও। দেড় বছরের বেশি সময় বাকি থাকায় নির্বাচনের আগের বছর বাজেটে ভোটার তুষ্টির জন্য নানামুখী প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। আর তাই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বাজেটের অর্থ বরাদ্দের খাত সাজানো হচ্ছে। যেসব খাতে সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে সরাসরি ভোটার তুষ্টির বিষয় সম্পৃক্ত, আগামী বাজেটে সেসব খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ গত অর্থবছরের তুলনায় বাড়ানোর ঘোষণা আসছে, আবার সুবিধাভোগীর আওতাও সম্প্রসারিত করা হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। এর আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। সে হিসেবে বর্তমান সরকার আর মাত্র দুটি বাজেট দেয়ার সুযোগ পাবে। এর মধ্যে আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরে পূর্ণাঙ্গ বাজেট উপস্থাপন ও বাস্তবায়ন করতে পারবে। এর পরের বছর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেট উপস্থাপন করলেও বাস্তবায়নে সময় পাবে না বললেই চলে। এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন বাজেটই হবে সরকারে নির্বাচনী বাজেট। তাই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বাজেটের অর্থ বরাদ্দের খাত সাজানো হচ্ছে। বাজেটে আর কোন কোন খাতে নজর দিলে ভোটারদের আকৃষ্ট করা যাবে, সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। এছাড়া করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে, তা পুনরুদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতেও নতুন রূপরেখা থাকছে বাজেটে। ভোটারদের তুষ্ট রাখতে বাজেটে নানা খাতে দেয়া ভর্তুকিতেও বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। এরই মধ্যে সংশোধিত বাজেটে ১২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনায় অনেক হতদরিদ্র মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে এরই মধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ ভোরের কাগজকে বলেন, আগামী বাজেটকেই বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট বলে ধরতে হবে। এমনিতেই এবারের বাজেট হবে চ্যালেঞ্জিং। কারণ করোনা বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের একটি প্রসঙ্গ রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব সারা বিশ্বে পড়েছে। এতে বাংলাদেশ সরাসরি প্রভাবিত হবে। কারণ তেল, গমসহ আমদানিকৃত পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে। তাই এ বিষয়টি মোকাবেলার কথাও মাথায় রাখতে হবে। তৃতীয়ত, যেহেতু এটাকেই সরকারের নির্বাচনী বাজেট বলা যায়, কারণ আগামী বছরে বাজেট দিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এজন্য বাজেটে শুধু বরাদ্দ দিলেই হবে না, তা সঠিক বাস্তবায়নও প্রয়োজন। তাই এবার এমন একটি বাজেট দিতে হবে যেন তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। এ তিনটি চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই সরকার এবার বাজেট তৈরি করবে বলে মনে করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণাঙ্গ বাজেট। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় উন্নয়ন প্রকল্প নেয়ার উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যা, তাতে এ ধরনের প্রকল্প নেয়া এবং নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্প চালু রাখা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে এমন সব উদ্যোগ দরকার যাতে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়ে। কৃষি উৎপাদন খরচ কম হয়। এজন্য সার ও জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর হতে হবে।
পণ্যের দামেও লাগাম টানায় কাজ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব ও পরিবহনে চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। সরকারকে কঠোর হাতে এসব বন্ধ করতে হবে। আর এসব করতে পারলেই জনগণের মুখোমুখি হওয়া সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি।
জানা গেছে, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র মানুষের জন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিবন্ধী, বেদে, তৃতীয় লিঙ্গ, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানীসহ আরো কয়েকটি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর আভাস রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোরও চিন্তাভাবনা চলছে। সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সামাজিক কল্যাণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মসৃজন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, কাবিখা, ভিজিএফ, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি ইত্যাদি। এছাড়া আসন্ন বাজেটে খাদ্য নিরাপত্তার দিকটি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
আগামী ৯ জুন বিকালে জাতীয় সংসদে ঘোষিত হতে পারে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট। এটি হবে বাংলাদেশের ৫২তম ও বর্তমান সরকারের টানা ১৪তম এবং অর্থমন্ত্রীর চতুর্থ বাজেট। নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হতে পারে ৬ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয় ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ফলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাজেটে আরো ১১ লাখ উপকারভোগীকে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে ১০০ উপজেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। নতুন ১১ লাখসহ মোট উপকারভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৮ লাখ। এতে সরকারের ব্যয় বাড়বে ৫০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ৫৭ লাখ উপকারভোগী বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। চলতি অর্থবছরে বাজেটে বয়স্ক ভাতার জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ১১২ উপজেলায় বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে দরিদ্রপ্রবণ আরো ১৫০ উপজেলার বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত নারীকে ভাতার আওতায় আনা হয়। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরো ১০০ উপজেলা যুক্ত হচ্ছে। ফলে দেশের ৩৬২ উপজেলার বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত নারীরা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আসছেন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এরই মধ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ শুরু করেছে অর্থ বিভাগ ও এনবিআর। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, বিশেষজ্ঞ ও সংগঠনের সঙ্গে ধারাবাহিক প্রাক বাজেট আলোচনাও করছে এনবিআর। এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আসছে বাজেটের বিভিন্ন অগ্রাধিকারের বিষয়ও ঠিক করছে সরকার। চলমান মেগা প্রকল্প হিসেবে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেলসহ চলমান বৃহৎ প্রকল্পগুলোর কাজ নির্বাচনের আগেই শেষ করতে চায় সরকার। এজন্য আসছে বাজেট জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার ফলে পণ্য পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়েছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। খুব শিগিগরই এ মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসার সম্ভাবনা নেই। দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখন পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ, যা গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। সংস্থাটি বলছে, পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির যে তথ্য দিচ্ছে, তা সঠিক নয়। বাস্তব অবস্থা আরো ভয়াবহ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজেটকে অনেক বেশি যৌক্তিক করতে হবে। ব্যয় যতটা সম্ভব কমাতে হবে। ঘাটতি যতটা সম্ভব কম রাখা দরকার। আমাদের আয়ের সংস্থান দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। সেটা সম্প্রসারণ করতে হবে।
ভর্তুকি বাড়ছে সংশোধিত বাজেটে : এদিকে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকি বাড়ছে। ভর্তুকির শীর্ষে এলএনজি ও কৃষি খাত। মূল বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ আছে ৪০ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকি বাড়ানো হচ্ছে ১২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। গ্যাসের সরবরাহ গতিশীল রাখতে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। তাই এ খাতে ভর্তুকি বাড়ানো হচ্ছে ৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সংশোধিত বাজেটে বাড়ানো ভর্তুকির প্রায় অর্ধেক এলএনজি আমদানিতে বরাদ্দ দিতে হচ্ছে। এর পরই আছে বিদ্যুৎ ও কৃষি খাত। এর মধ্যে বিদ্যুতে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা এবং কৃষি খাতে আড়াই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাড়ছে।
জানা গেছে, করোনাপরবর্তী পরিস্থিতিতে চাহিদা বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির মূল্য বেড়ে যাওয়া এবং সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকির চাপ বাড়ছে। এরই মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় ২৮ হাজার কোটি এবং বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ৩২ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ভর্তুকি দাবি করেছে। এ অবস্থায় আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ভর্তুকি বাড়াতে হচ্ছে। এলএনজি, গ্যাস, তেলবীজ, সুদ ও টিসিবি খাতে মোট মূল ভর্তুকি বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এসব খাতে ভর্তুকি বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ভর্তুকি বেড়ে দাঁড়াবে ১২ হাজার কোটি টাকা। কৃষি খাতে মূল ভর্তুকি ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ভর্তুকি বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকা।
বাজেট বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ রশিদ লালী এ প্রসঙ্গে বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনাপরবর্তী যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলো মোকাবিলা করতে হবে। এছাড়া সামনে নির্বাচন রয়েছে সেদিকেও সরকারের নজর থাকবে।ডি-ইভূ