ডলারের বাজারেও মজুতদারি!

প্রতীকী ছবি

ডলারের দাম গত দুদিনে কিছুটা কমেছে। তবে খোলাবাজারে এখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দামের তুলনায় অনেক বেশি দামে ডলার কেনাবেচা চলছে। ঢাকার বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ ঘুরে এবং ডলার কেনাবেচার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, নিত্যপণ্যের বাজারের মতো মুদ্রাবাজারেও সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকার ও ট্রেডারদের যোগসাজশে ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তেল মজুতকারীদের মতো মুদ্রা মজুতকারীরাও অতি মুনাফার আশায় মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। নীতিনির্ধারকরা এখনই হস্তক্ষেপ না করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এমনকি হুন্ডিতে অবৈধ লেনদেন বাড়ার আশঙ্কাও রয়েছে বলে মনে করেন তারা।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রির অভিযোগ থাকলেও এবার সরকারি ব্যাংকও একই পথে হাঁটছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো বলছে, অনেক দিন থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। তাই তারাও এ পথে হাঁটা শুরু করেছে। তবে গত বুধবার এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকের বৈঠক হয়েছে। এখন থেকে সব ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে চলবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।

ডলারের অস্থিরতা কমাতে এবার কথা বললেন স্বয়ং সরকারপ্রধান। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে ডলার সংকট সমাধানের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টির সমাধান করবে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ সভা শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের একথা জানান।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, ডলার মূলত চাহিদার ওপর নির্ভর করে। তাই চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে, সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ যদি ব্যাংকমুখী হয়, তাহলে বাইরের তুলনায় রেট অনেক কম পাবে। এছাড়া ব্যাংক ডলার দিতে পারবে না- একথা বলার কোনো সিস্টেম নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে একটি নির্ধারিত রেট দিয়ে থাকে। এমনকি প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের সাপোর্টও দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী, ৫ বিলিয়ন ডলার সাপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি ব্যাংকমুখী না হয়, সচেতন না হয়- তাহলে খোলাবাজারে দাম বাড়বেই।

মানুষ কেন ব্যাংকমুখী হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাংকে ডলার কিনতে গেলে কিছু নিয়ম মানতে হয়। কাগজপত্র জমা দিতে হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়মে আসার বিষয়ে এখনো দুর্বলতা রয়েছে।

একদিনের মধ্যেই খোলাবাজারে ডলারের দাম কমে যাওয়ার বিষয়ে এ ব্যাংকার বলেন, হঠাৎ ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কঠোরভাবে তদারকি শুরু করেছি। চারটি টিম গঠন করে তাদেরকে ব্যাংকসহ বিভিন্ন স্থানে মনিটরিংয়ের জন্য পাঠিয়েছি। সেখানে আমরা খুঁজে পেয়েছি, যারা দেশের বাইরে যাচ্ছেন, যে কারণেই যাক, তারা নিয়মের মধ্যে আসতে চাননি বলেই বেশি টাকা দিয়ে বাইরে থেকে ডলার কিনে চলে যাচ্ছেন। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা ডলারের দাম বাড়িয়েছে বলে জানান তিনি।

দেশের খুচরা বাজারে (কার্ব মার্কেট) সোমবার প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল সর্বোচ্চ ৯৬ টাকা। একদিন পরই মঙ্গলবার আকস্মিকভাবেই ডলারের বিনিময় হার ১০০ টাকা পার হয়ে যায়। কার্ব মার্কেটে দিনভর প্রতি ডলার বেচাকেনা হয়েছে ১০২ টাকায়। সন্ধ্যার পর তা ১০৩-১০৪ টাকায়ও বিক্রি করেছে মানি এক্সচেঞ্জগুলো। তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকিতে এ বাজারে স্থিরতা ফিরতে শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এদিকে বাজারে এক ধরনের গুঞ্জন উঠেছে, বাজারে ডলারের দাম আরো বাড়তে পারে। ১০৭ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠতে পারে- এমন আশায় অতি মুনাফালোভীরা খোলাবাজার থেকে ১০০ টাকার বেশি দরে ডলার কিনেছিলেন। দাম কমতে থাকায় তাদের মাথায় হাত।

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এরপর থেকে বাংলাদেশেও ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে। একই সঙ্গে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় দেশে ব্যাপক হারে পণ্য আমদানি বেড়েছে। আবার করোনার পর বিদেশ ভ্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ডলারের চাহিদাও বেড়েছে। অন্যদিকে রেমিট্যান্স কমেছে। জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে, যা ছিল আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। বিদেশি পর্যটক ও নগদ ডলার আসছে কম। ফলে বাড়তি চাহিদার কারণে লাফিয়ে বাড়তে থাকে ডলারের দাম। রিজার্ভের ডলার বিক্রি করেও ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বিপাকে পড়েছেন পর্যটক ও চিকিৎসার জন্য বিদেশগামী যাত্রীরা। দুশ্চিন্তায় রয়েছেন হজযাত্রীরাও। মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও দামের লাগাম টানা যাচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের গত সোমবার পর্যন্ত (সাড়ে ১০ মাসে, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ১৬ মে পর্যন্ত) ৫২০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও বাজারের অস্থিরতা কাটছে না।

এদিকে ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্য বেড়ে যাওয়ায় অবৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। কারণ ডলারের দামের পার্থক্য আগে কখনো এত বেশি হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি বাড়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের দাম বাড়ছে। এজন্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়াতে বড় উদ্যোগ নিতে হবে। আর খোলাবাজারে সংকট কাটাতে কেউ যাতে সীমার বেশি নগদ ডলার বিদেশে নিতে না পারেন, তার তদারকি জোরদার করতে হবে।

সর্বশেষ গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলারের দাম ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এ দাম নির্ধারণের পরদিনই প্রথমবারের মতো খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ১০২ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। একই সঙ্গে বাজারে ডলারের সংকটও দেখা দেয়। এ অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পর গত দুই দিনে খোলাবাজারে ডলারের দাম কিছুটা কমেছে।

ডলারের দামের বিষয়ে পল্টনের ক্যাপিটাল এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন বলেন, ডলারের দাম কিছুটা কমেছে। দুদিন আগে প্রতি ডলারের দাম ১০১ টাকা হয়েছিল। আজ আমরা ডলার ৯৬ থেকে ৯৬ টাকা ৫০ পয়সা করে কিনেছি। বিক্রি করেছি ৯৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৯৭ টাকা ৬০ পয়সায়। মতিঝিলের পাইওনিয়ার মানি চেঞ্জারের কর্মী রোকন বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) আমরা ডলার বিক্রি করেছি ৯৮ টাকা দরে। কিনেছি ৯৭ থেকে ৯৭ টাকা ৫০ পয়সায়।

বেড়েছে আমদানি ব্যয় : চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। রেকর্ড আমদানির এলসি দায় পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক। এতে ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ফলে দেশের বাজারে শক্তিশালী প্রতিটি বৈদেশিক মুদ্রারই দাম বেড়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে প্রায় প্রতিদিনই বাজারে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে রিজার্ভ থেকে প্রায় ৫১০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর পরও বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে সোমবার ডলারের ঘোষিত বিনিময় হার ছিল ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও দাম কমলেও এ হারে দেশের কোথাও ডলার মিলছে না। এর আগে গত বছরের জুনে প্রতি ডলারের ঘোষিত বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ৩ হাজার ৬৬১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি। বিপরীতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে দেশে ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৯০ কোটি ডলারে। এতদিন বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থ। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এ সময়ে দেশে ১ হাজার ৫২৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাবদ ৯ মাসে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে ৫ হাজার ১৯২ কোটি ডলার।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে গড়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৬৮৩ কোটি ডলার। অর্থবছরের বাকি তিন মাসে একই হারে আমদানি হলে বছর শেষে দেশের আমদানি ব্যয় ৮২ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। রেকর্ডসর্বোচ্চ এ আমদানি প্রবৃদ্ধি চলতি হিসাবের ঘাটতিকে ২০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় আমদানিতে লাগাম টানার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যক্তিগত গাড়ি, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর আমদানি ঋণপত্রের ন্যূনতম নগদ মার্জিন ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়, এমন পণ্যের নগদ মার্জিন নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে ৫০ শতাংশ।

LEAVE A REPLY