প্রতীকী ছবি
ডলারের অস্থিরতায় শেয়ার বিক্রি করছে বিদেশিরা, যাচাই-বাছাই করে মার্জিন ঋণ দেয়ার দাবি
বিশ্বের পুঁজিবাজারের ধাঁচে চলে না দেশের বাজার। কোনো ধরনের গুজব তৈরি হলেই আতঙ্কে থাকেন বিনিয়োগকারীরা। শেয়ারের দাম কমলে যেমন প্যানিক সৃষ্টি হয়, বাড়লেও তেমনি। খুব সামান্য কারণেও পুঁজিবাজারে আতঙ্ক তৈরি হয়। এছাড়া বৈশ্বিক অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব তো আছেই। সম্প্রতি ডলারের অস্থিরতার কারণে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির খবরেও বিনিয়োগকারীদের মাঝে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে।
এক শ্রেণির অসাধুরা বাজারে গুজব তৈরি করছে। সব মিলিয়ে গত ঈদের দুদিন পর থেকে যে অস্থিরতা শুরু হয় দেশের পুঁজিবাজারে, তা এখনো চলমান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল রবিবারও পুঁজিবাজারে শেয়ারের ব্যাপক দরপতন হয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে অর্থাৎ বাজারে তারল্য বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) মার্জিন ঋণে শিথিলতা এনেছে।
পুঁজিবাজারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঈদের পরবর্তী দুদিন ভালো থাকলেও পরবর্তী টানা আট কার্যদিবস ধরে পুঁজিবাজারের বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার দর কমছে। পরবর্তী সময়ে সূচকের বেশি পতন হয় গত সোমবার। এদিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক কমেছিল ১৩৪ পয়েন্ট। পরবর্তী প্রতি কার্যদিবসে সূচকের পতন হয়েছে। গত সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অর্থাৎ গত সপ্তাহের চার কার্যদিবসেই সূচক কমেছে ৩০৭ পয়েন্ট। এই পতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে গতকাল রবিবারও। এদিন সূচক কমেছে ১১৫ পয়েন্ট। এ নিয়ে ঈদ পরবর্তী আট কার্যদিবসেই সূচক কমেছে ৫১২ পয়েন্ট। পাশাপাশি বিগত ১ মাসের হিসাবে ১৭ কার্যদিবসের ১০ কার্যদিবসেই দরপতন হয়েছে পুঁজিবাজারে। লেনদেন হওয়া কোম্পানি ও ফান্ডগুলোর ৮৯ শতাংশের দর কমেছে। আর বিগত ১ মাসের দরপতনে বাজারের ৮১ শতাংশ কোম্পানি ও ফান্ডের দরপতন হয়েছে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণেও বাজারে এক ধরনের গুজব রটেছে। যার কারণে অনেকে ফোর্স সেল করে বাজার থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। ফলে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে বড় ধরনের ফারাক তৈরি হয়েছে। আর বিশ্ববাজারের অস্থিরতা তো আছেই। এ বিষয়ে শাকিল রিজভী স্টকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী ভোরের কাগজকে বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বাজারের পতন হয়েছে। এছাড়া ডলারের অস্থিরতার কারণেও অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করেছেন। এতে বাজারে বিক্রয় চাপ বেড়েছে। মূলত এসব কারণে পতন হয়েছে পুঁজিবাজারে।
ডিএসইর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঈদের পর পুঁজিবাজারে প্রথম লেনদেন হয়েছে ৪ মে। সেই দিন থেকে ২২ মে পর্যন্ত মোট ১১ কর্মদিবসের মধ্যে ৯ কর্মদিবস দরপতন হয়েছে। এছাড়া ঈদের আগের সর্বশেষ কর্মদিবস পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব সংখ্যা ছিল ২০ লাখ ৭৯ হাজার ২১৫টি। এর মধ্যে সক্রিয় বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৯ হাজারটি। সেখান থেকে ৩৭ হাজার ২৪৩টি কমে ২১ মে পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭১ হাজারটিতে। এর মধ্যে ঈদ পরবর্তী কর্মদিবস ৪ মে থেকে ২১ মে পর্যন্ত মোট ১০ কর্মদিবসে প্রায় ৩৫ হাজার বিওধারী সব শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছেড়েছেন। এদিকে এই সময়ে নতুন করে ৩৮ হাজার ৫৪১টি বিওধারী বিনিয়োগকারী নিষ্ক্রিয় হয়েছেন। নিষ্ক্রিয় বিওধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯১ হাজারটিতে। অর্থাৎ ২০ লাখ ৮১ হাজার বিওধারীর মধ্যে ৪ লাখ ৯১ হাজারটি নিষ্ক্রিয়। যা মোট বিও হিসাবের ২৪ শতাংশ। এছাড়া ডলারের অস্থিরতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছেড়েছেন।
বাজারের সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাব দেশের বাজারে পড়েছে। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতির তুলনায় বাজারে প্যানিক ছিল বেশি। কারণ বিশ্বের অন্যান্য পুঁজিবাজারের মতো দেশের পুঁজিবাজার চলে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারীরা ডিভিডেন্ড গেইনের আশায় বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। আর আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা ক্যাপিটাল গেইনের জন্য বিনিয়োগ করেন। যার কারণে দাম বাড়লে বা কমলে হা হুতাশ লক্ষ্য করা যায়। এই কারণে তারা প্যানিকে প্রভাবিত হন বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
পুঁজিবাজারের ধারাবাহিক পতন ঠেকাতে বাজারে তারল্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। এরই ধারাবাহিকতায় বিএসইসি মার্জিন ঋণের সীমা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিএসইসির নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিনিয়োগকারীরা এখন তাদের বিনিয়োগের বিপরীতে সমপরিমাণ ঋণ পাবেন ব্রোকারেজ হাউস থেকে। অর্থাৎ কারো বিনিয়োগ ১০০ টাকা থাকলে তিনি ১০০ টাকা ঋণ পাবেন। বিএসইসির আদেশে বলা হয়, যে কোনো সিকিউরিটিজের প্রাইজ আর্নিংস (পিই) রেশিও ৪০-এর নিচে হলে মার্জিন ঋণের সর্বোচ্চ সীমা হবে ১:১। অর্থাৎ গ্রাহকের তহবিলে ১০০ ভাগ হিসেবে প্রযোজ্য হবে। এ আদেশ অনতিবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও জানানো হয় এই আদেশে। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বিনিয়োগ সংস্থানের আশায় নতুন নতুন সিকিউরিটিজ হাউস অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। পাশাপাশি অন্যান্য সিকিউরিটিজ হাউসগুলোকে দেশ-বিদেশে বুথ খোলারও অনুমতি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এছাড়া অবণ্টিত লভ্যাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (সিএমএসএফ) গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই পতন থামছে না পুঁজিবাজারে। এছাড়া পুঁজিবাজারে চাহিদার তুলনায় জোগানের পরিমাণ বাড়ায় তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকটও সৃষ্টি হয়েছে। দরপতনের মধ্যেই প্রতিদিনই নতুন নতুন গুজব সৃষ্টি করছে বিশেষ কিছু চক্র। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তা বাজারের দরপতনকে দীর্ঘায়িত করেছে।
এ বিষয়ে ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি রিচার্ড ডি’ রোজারিও ভোরের কাগজকে বলেন, পুঁজিবাজারের উত্থান-পতন স্বাভাবিক বিষয়। তবে দেশের পুঁজিবাজারে এই পতন স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। এ জন্য মূলত প্যানিকই দায়ী। এছাড়া যারা অবাধে মার্জিন ঋণ বিতরণ করছেন তাদেরও দায় রয়েছে। ভবিষ্যতে পুঁজিবাজার ভালো করার জন্য বুঝে-শুনে এবং যাদের ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা রয়েছে এমন বিনিয়োগকারীকে ঋণ দেয়ার পরামর্শ ডিবিএ সভাপতির।ডি- এইচএ