জিডিপি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা

বৈশ্বিক সংকট বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থাগুলো বলছে, শুধু যুদ্ধের কারণে বিশ্বের প্রবৃদ্ধি অন্তত এক শতাংশ কমবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এরই মধ্যে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। অর্থনীতির সুরক্ষায় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এমন সংকটের মধ্যেও আগামী অর্থবছরের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) চলতি বাজার মূল্যে ৪৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে অর্থ বিভাগ। এটি চলতি জিডিপির চেয়ে ১৪ লাখ কোটি টাকারও বেশি। স্থিরমূল্যে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করছে, আগামী বছরগুলোয় প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পেছনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, যোগাযোগ ও পরিবহণ খাতের উন্নয়ন সম্পৃক্ত হবে। এসব খাতের উন্নয়নের প্রভাব শিল্পসহ অন্যান্য খাতের প্রবৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৃষি খাতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এজন্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত ও ভর্তুকি অব্যাহত রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়। বিভিন্ন খাতে চলমান সংস্কার কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন হলে প্রবৃদ্ধি অর্জন জোরদার হবে বলে হিসাব করা হচ্ছে।

সূত্র আরও জানায়, আগামী অর্থবছরে বড় তিনটি মেগা প্রকল্প চালু হবে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের জুনেই খুলে দেওয়া হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এর ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের দুয়ার নতুন করে খুলবে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এই সেতু চালুর পর জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি যোগ হবে প্রায় ১ দশমিক ৫০ শতাংশ। এর পরপরই রাজধানীর উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটবে মেট্রোরেল। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের সুড়ঙ্গপথও চালু হয়ে যাবে ততদিনে। এই তিনটি প্রকল্প চালু হলে জিডিপিতে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে প্রায় ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ হবে। জিডিপির আকার বৃদ্ধির পেছনে এসব দিক থেকে প্রত্যাশা করছে সরকার।

জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, স্বাভাবিক অবস্থায় প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার মূল নিয়ামক। প্রবৃদ্ধি না হলে অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসবে। শুরু হবে জনদুর্ভোগ। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির মূল সুবিধা পায় ধনী ব্যক্তিরা। গরিব জনগণ ‘চুইয়ে পরা’ (trickle down effect)-এর মাধ্যমে কিছুটা সুবিধা পায়। ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে প্রবৃদ্ধির সুবিধা নিুআয়ের মানুষ কম পেয়েছে। এতে বৈষম্য বাড়ছে। এখন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়িয়ে এ বৈষম্য ও দরিদ্রতা কমিয়ে আনতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) বাজার মূল্যে জিডিপি অর্জন হবে ৩০ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। এর চেয়ে ১৪ লাখ ১০ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বেশি ধরে আগামী অর্থবছরের জন্য বাজার মূল্যে জিডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এর আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) ছিল ২৮ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা।

অর্থ বিভাগের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও সারের মূল্য সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। কিন্তু সরকার সারে ভর্তুকি দিচ্ছে। ফলে বেশি দামে সার কিনলেও কৃষককে কম দামে দেওয়া হচ্ছে। আগামী বছর একইভাবে ভর্তুকি দেওয়া হবে। যে কারণে আগামী অর্থবছরে কৃষিতে ১২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, এতে কৃষি খাতে কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটবে না। আবহাওয়া ঠিক থাকলে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি উৎপাদন ভালো হবে। এতে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। এছাড়া করোনার অতিমারিতেও কৃষি খাতে ঋণাত্মক প্রভাব পড়েনি। ফলে আগামী বছরে কৃষি খাতের অবদান যোগ হবে জিডিপিতে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়, আগামী বছরে সব শিল্পের উৎপাদন সূচকের প্রবৃদ্ধি হবে। কারণ নতুন বাজেটে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখা হবে। ফলে উদ্যোক্তারা এ প্যাকেজের সুবিধা নিয়ে শিল্পে ব্যবহার করতে পারবেন। এটি যোগ হবে খাতভিত্তিকভাবে জিডিপিতে। যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন আসছে আগামী বছর। বড় তিনটি প্রকল্প চালু হলে এর অবদানও যোগাযোগ খাতে এসে পড়বে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু, ঢাকায় মেট্রোরেল পুরোদমে চললে, কর্ণফুলী টানেল খুলে দিলে বাংলাদেশে উন্নয়নের নতুন ছোঁয়া লাগবে। শুধু টানেল কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। ফলে ২০২৩ সালে অবকাঠামো সামর্থ্যে ভিন্ন এক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির দিগন্ত বদলে যাবে। এর সুস্পষ্ট প্রভাব পড়বে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। সবচেয়ে বেশি যোগ হবে পরিবহণ, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ খাতে।

LEAVE A REPLY