সরকারের ৭২৭ কোটি টাকা অপচয়ের শঙ্কা

গরিব ও অসহায় মানুষের সহায়তার জন্য প্রতিবছর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে মোটা অঙ্কের অর্থব্যয় করে সরকার। বরাবরই অভিযোগ উঠে এর সুবিধাভোগী (প্রকৃত গরিব) নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে দেশের দরিদ্র মানুষের তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এজন্য ‘ন্যাশনাল হাউজহোল্ড ডেটাবেজ (এনএইচডি)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। কিন্তু এ প্রকল্পটিতেও রয়েছে নানা অনিয়ম এবং বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা। ত্রুটিপূর্ণ তথ্যে তৈরি করা হয়েছে ডেটাবেজ। যেটি কোনো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ কারণে ৭২৭ কোটি টাকা অপচয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া যোগ্য প্রকল্প পরিচালকসহ দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বসে বসে বেতনভাতা নিচ্ছেন ২৮৭ জন ডেটা এন্ট্রি অপারেটর। পরামর্শকসহ অন্যরাও দায়িত্ব পালন করেননি। চার বছরের এ প্রকল্পটিতে সাড়ে ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি কাজ। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের থার্ড পার্টি (তৃতীয় পক্ষ) মূল্যায়নে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। ‘দ্বিতীয় খসড়া’ প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করার কাজ করছে সংস্থাটি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, থার্ড পার্টির মাধ্যমে আইএমইডির যে মূল্যায়ন, এগুলো অবশ্যই অনিয়ম এবং দুর্নীতির মধ্যেই পড়ে। সেই সঙ্গে প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব তথ্য তুলে আনা হয়েছে, সেগুলো যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় এবং ব্যবহার করা না যায়, তাহলে পুরো অর্থই অপচয় হওয়ার শামিল। এ প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এরকম কার্যক্রম গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া এটি কোনো সাধারণ প্রকল্প ছিল না। সরকারের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের দায়িত্বে অবহেলা কেন হবে। শুরু থেকে যারা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। শুধু প্রতিবেদন তৈরি করলেই হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্প দীর্ঘায়িত করে একটি মহল সুবিধা অর্জন করে। এটা প্রকল্পের সংস্কৃতি হিসাবেই দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক কাজী তোফায়েল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এই প্রতিবেদনে অনেক ভুল আছে। আইএমইডি সচিব ও আমাদের সচিব (পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ) মিলে বসে ঠিক করবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। ‘নো কমেন্টস’। যদি কথা বলার প্রয়োজনই হয়, তাহলে ফোনে বলতে পারব না। অফিসে আসেন।

আইএমইডির খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি গ্রহণের যেসব উদ্দেশ্য ছিল, তা সার্বিক বিবেচনায় অর্জন করা সম্ভব হয়নি। প্রকল্পের আওতায় গৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা অসম্পূর্ণ ডেটাবেজ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে প্রকল্পের কোনো উদ্দেশ্য অর্জিত হচ্ছে না। প্রকল্পের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় এটির আউটপুট ব্যবহারযোগ্য নয়। আরও বলা হয়েছে, ত্রুটিপূর্ণ এনএইচডি ডেটাবেজ ব্যবহার করে সঠিকভাবে দরিদ্র জনেগোষ্ঠীকে লক্ষ্যভুক্ত করা সম্ভব নয়।

এছাড়া দরিদ্রদের লক্ষ্যভুক্তির কৌশল সহজতর করাও সম্ভব নয়। ফলে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বা প্রকল্পের প্রকৃত সুবিধাভোগী নির্বাচন ও দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব হবে না। প্রকল্পে নিয়োগ করা ৫৪৫ জন ডেটা এন্ট্রি অপারেটর নিয়মিতভাবে ২০১৬ সাল থেকে বেতনভাতা প্রকল্প থেকে নিয়ে আসছেন। তাদের মধ্যে বর্তমানে কর্মরত ২৮৭ জন। কিন্তু তারা প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মিত কাজকর্ম বা দায়দায়িত্ব পালন করছেন না। ফলে এক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় অর্থব্যয় বলে প্রতীয়মান হয়। কিছু ক্ষেত্রে সংগৃহীত তথ্য আইসিআর ফার্ম স্ক্যানিং করার সময় যথাযথভাবে কোয়ালিটি কন্ট্রোল করেনি। ফলে নাম, বয়স প্রভৃতি ফিল্ডে ভুলের কারণে ত্রুটিপূর্ণ ডেটাবেজ তৈরি হয়।

এ পরিপ্রেক্ষিতে স্ক্যানিং করা তথ্য ফার্মকে পুনরায় কারেকশন করতে হচ্ছে। আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ করা হলেও ডেটাবেজে অসংগতি পাওয়া গেছে। ফলে পরামর্শকরা তাদের কার্যপরিধি অনুযায়ী যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। এজন্য প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। প্রকল্পের আওতায় সংগৃহীত তথ্য যথাযথ এডিটিং না করে সরাসরি স্ক্যান করা হয়। এতে পরিসংখ্যানের নিয়মাবলি বিচ্যুতি হয়েছে। এছাড়া প্রকল্প পরিচালক হিসাবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ না দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে প্রকল্পটি ব্যুরোর অধীনস্থ কোনো উইংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকায় বিবিএস সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রকল্পে একাধিক আইটি কনসালটেন্ট এবং বিবিএস-এর একাধিক সিনিয়র প্রোগ্রামার নিয়োগ দেওয়া হলেও বাস্তবে তারা উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ করেননি। ফলে প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ডিডিএম (ডিরেক্টরেট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট)-এর মাধ্যমে এনএইচডি এমআইএস এখনো প্রস্তুত না হওয়ায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেরি হচ্ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, অর্থ অপচয়ের বিষয়টি ঠিক নয়। কেননা কাজ তো হয়েছে। ভুলত্রুটি যেগেুলো হয়েছে, সেগুলো ওই ফার্মের মাধ্যমেই সংশোধন করা হচ্ছে। এর জন্য আলাদা কোনো টাকা দিতে হবে না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বব্যাংক এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ফলে সার্বিক প্রকল্পটির বাস্তবায়ন দেরি হচ্ছে। তিনি জানান, আরমেনিয়ার পরামর্শক দিয়ে এই এমআইএস করার কথা। কিন্তু করোনাসহ নানা কারণে তারা কাজ করতে আসতে পারেননি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি।

সূত্র জানায়, ‘ন্যাশনাল হাউজহোল্ড ডেটাবেজ (এনএইচডি)’ প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ৩২৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের অর্থও রয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৬৯৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এরপর দ্বিতীয় সংশোধনীতে আরও বৃদ্ধি পেয়ে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৭২৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এছাড়া মূল অনুমোদনের সময় ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। এতে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রথম সংশোধনীর সময় ২০১৮ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপর দ্বিতীয় সংশোধনীতে ছয় মাস বাড়িয়ে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এতেও শেষ হয়নি কাজ। এবার ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে দুই বছর বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। সর্বশেষ দেড় বছর মেয়াদ বাড়িয়ে চতুর্থ সংশোধনীতে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পটির ক্রমপুঞ্জিত বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯২ শতাংশ। এ সময় পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৬৩৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৮৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ৩ কোটি পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থার চিত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।

LEAVE A REPLY