তামিম ইকবাল, আপনাকেও ধন্যবাদ

‘আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে আজকে থেকে আমাকে অবসরপ্রাপ্ত হিসেবে বিবেচনা করুন। ধন্যবাদ সবাইকে’, রবিবার ভোররাতে তামিম ইকবালের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্ট নিয়ে দিনভর আলোচনা হচ্ছে। অনেকের ধারণা, অভিমানে এই পোস্ট দিয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক। কেউ সাধুবাদ জানিয়েছেন।

কেউ বা টি-টোয়েন্টিতে দলের বর্তমান অবস্থায় তামিমের এই সিদ্ধান্তের সময়োপযোগিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ফেসবুকে পোস্ট না দিয়ে হাজার দর্শকের সামনে খেলেও তো বিদায় নিতে পারতেন তামিম।

তামিম ইকবালের নিজের দর্শন ভিন্ন। রবিবার সকালে টেলিফোনে এই ঘোষণা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়ে দেন, ‘এটা নিয়ে আমি কোনো কথা বলব না। যা বলেছি, তা দুই লাইনের (ফেসবুক) পোস্টেই তো দেখেছেন। ’

ক্রিকেট তাঁর পেশা, প্যাশনও। যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্যই অবসর বলে দেওয়া সহজ নয়। কিন্তু টেলিফোনের অপর প্রান্তে তামিম ইকবালের কণ্ঠস্বরে বেদনার ছাপ নেই। বরং দেশের বাইরে আরেকটি ওয়ানডে সিরিজ জয়ের আনন্দই বেশি স্পষ্ট।

এটাই তামিম ইকবাল। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তামিম ইনি নন। পরিণত বললে সামান্যই বলা হবে, এখনকার তামিমের জীবনদর্শনটাই ১৮০ ডিগ্রি বদলে গেছে। ‘আপনি আমার এত দিনের ক্যারিয়ার কি কেড়ে নিতে পারবেন? পারবেন না। আমার ক্যারিয়ারে ফুলস্টপ আমিই দেব। যেদিন দেব, সামান্যতম দুঃখও থাকবে না’, মাস তিনেক আগে নিজের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ নিয়ে এমনটাই বলেছিলেন তামিম। সেদিনের উচ্চারণে অভিমান কি মিশে ছিল? ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে সেসব শব্দমালায় নিজের ক্রিকেট-জীবন নিয়ে গর্ব ছিল। এই গর্ব যেকোনো ‘অ্যাচিভারে’র অলংকার।

টি-টোয়েন্টিতে তামিম ইকবাল কি সেই অর্থে ‘অ্যাচিভার’? প্রশ্নটা পুরনো। টি-টোয়েন্টিতে তাঁর স্ট্রাইক রেট নিয়ে মিডিয়া হয়ে জনতায় ছড়িয়ে পড়ে এই প্রশ্ন। এর বিস্তার ঘটে ক্রিকেট প্রশাসকদের বোর্ডরুম থেকে টিম ম্যানেজমেন্টেও। যদি তামিমের এই অবসর ঘোষণার পেছনে অভিমান থেকেই থাকে, তবে সেটির সূতিকাগার বোর্ড এবং টিম ম্যানেজমেন্ট। সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়ারও প্রভাব নেই তামিমের সর্বশেষ ফেসবুক স্ট্যাটাসে।

এই বিশ্লেষণেও তামিমের ক্রিকেট-দর্শনের প্রভাব আছে। ‘আপনাদের (মিডিয়া) কাজ আপনারা করবেন। এর কোনোটা আমার ভালো লাগবে, কোনোটা লাগবে না। দর্শকের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু বলার সুযোগই নেই। তবে আপনাকে নিয়ে যদি আপনার পরিবারেই প্রশ্ন ওঠে, তখন বিষয়টা সিরিয়াস’, গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দল ঘোষণার মাসখানেক আগে কালের কণ্ঠকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তামিম। বিশ্বকাপের দল ঘোষণার প্রক্রিয়াকালেই খবর বেরিয়েছিল, চোটের কারণে আগের কয়েকটি সিরিজ খেলেননি তামিম। ওই সময় যাঁরা খেলেছেন, তাঁদের ওপরই বিশ্বকাপে আস্থা রাখতে চায় টিম ম্যানেজমেন্ট। সেসব আলোচনার সবই পৌঁছে যায় তামিমের কানে। ছয় মাসের ছুটির পর যে টি-টোয়েন্টিতে আর ফিরবেন না এই ফরম্যাটে, সেই সিদ্ধান্ত তিনি নিয়ে ফেলেন তখনই। বিষয়টি নিয়ে বোর্ড সভাপতির সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে তামিমের। নাজমুল হাসান সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কথা বলেছেন। কিন্তু তামিম নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। অভিমানে? হতে পারে। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দল গঠনের সময়কার আলোচনা তামিমের ভালো লাগার কোনো কারণ নেই।

আশ্চর্য লাগছে এটা ভেবে যে, তামিমের বিকল্প হিসেবে সে সময় যাঁদের কথা ভেবেছিল নির্বাচক কমিটি কিংবা টিম ম্যানেজমেন্ট, তাঁরা কেউ দৃশ্যপটেই নেই! পরিসংখ্যান বলছে, এই ফরম্যাটে এখনো তামিমই সবচেয়ে এগিয়ে। নিজের শেষ ৯টি টি-টোয়েন্টিতে ২৯.৭৭ গড়ে ২৬৮ রান করা এই বাঁহাতি ওপেনারের স্ট্রাইক রেট ছিল ১২৯.৪৬। সময়কাল বিবেচনা করলে পুরো বাংলাদেশ দলকেই তখন টি-টোয়েন্টির জন্য অনুপযুক্ত ঘোষণা করার কথা, এমনকি সাকিব আল হাসানকেও! কেননা ব্যাটিং পরিসংখ্যানে তখন কেউই তামিমের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন না।

এ ধরনের যুক্তি হাস্যকর। ক্রিকেট পরিসংখ্যান প্রায়ই এমন হাস্যকর তথ্য নিয়ে হাজির হয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এর চর্চা হয় সবচেয়ে নেতিবাচকভাবে। ক্রিকেটারদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের বিদেশি কোচরাও নাকি মাঝেমধ্যে পরিসংখ্যানের ‘কারসাজি’ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। পরিসংখ্যানে শুধু রান-বলের হিসাব থাকে, ম্যাচ পরিস্থিতির নয়। অথচ আধুনিক ক্রিকেটে ম্যাচ পরিস্থিতির গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি।

তো, তামিম ইকবাল নিজের একটি বড় উপকার করেছেন। টি-টোয়েন্টির স্ট্রাইক রেট নিয়ে বাড়তি চাপ আর তাঁকে নিতে হবে না। বরং ওয়ানডের জয়রথে চড়ে ক্রিকেট ক্যারিয়ারের বাকিটুকু আনন্দে কাটিয়ে দেন তিনি।

তামিম ইকবাল নিজেও আজকাল বলেন, ‘আমি একজন গর্বিত ক্রিকেটার। ক্রিকেট আমাকে অনেক দিয়েছে। আর কিছু চাওয়ার নেই। বাকি কটা দিন মনের আনন্দে খেলব। ’ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ‘ষোড়শ বর্ষে’ পা রাখা তামিমের লক্ষ্য এর বেশি কিছু নয়। টি-টোয়েন্টি তো একটি ফরম্যাট মাত্র। যে ফরম্যাটে মাহমুদ উল্লাহ (১১৮ ম্যাচে ২০৪৩ রান) ও সাকিবের (৯৯ ম্যাচে ২০১০) পর সবচেয়ে বেশি রান তামিমের, ৭৪ ম্যাচে ১৭০১ রান। তবে ব্যাটিং গড়ে মোট রানে এগিয়ে থাকা দুজন তো বটেই, অন্যূন ৫০টি টি-টোয়েন্টি খেলা বাংলাদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে তামিম। স্ট্রাইক রেটে এ ওর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন। তামিমের তাই হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই।

তামিম ইকবাল নিজে গর্বিত। লম্বা সময় সার্ভিস দেওয়ার জন্য তাঁকেও অশেষ ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY