বার্মিংহামে বাংলাদেশকে তুলে ধরছেন নিগার সুলতানারা

‘হ্যালো, চঞ্চল ভাইয়া, ম্যায় জোভেরিয়া হু! আর ইউ স্লিপিং?’ রোববার সকালে ঘুম ভাঙল ফোন কলটা পেয়ে। লন্ডন থেকে ফোন করেছে জোভেরিয়া। পাকিস্তানি মেয়ে। লন্ডনে আছে বছর দশেক ধরে। ২০০৪ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে পরিচয় হয়েছিল ওদের সঙ্গে। মিডিয়া সেন্টারে স্বেচ্ছাসেবী ছিল। অনেকেই কাজ করত। সবার কথা মনে নেই। যোগাযোগ এখনো আছে মোহাম্মদ আলী, খালিদ, ফারহান, মাহবিশ, নারিতাদের সঙ্গে। ই-মেইলের পাশাপাশি ফেসবুকে যোগাযোগটা বেশি হয়। রাওয়ালপিন্ডির ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল ওরা। বার্মিংহাম এসে পেলাম অন্যদের। কমনওয়েলথ গেমসের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর অংশ ওরা। বলতে গেলে গেমসের প্রাণ।

জলি, কিথ, রিচার্ড, মিশেল-ওরা সবসময়ই হাসিখুশি। দিনরাত পরিশ্রম করেও ওদের মুখভার নেই। ওয়ান ওয়ার্ল্ডের সব স্বেচ্ছাসেবীর চরিত্রই মনে হয় এক। ইসলামাবাদ থেকে ম্যানচেস্টার কিংবা বেইজিং থেকে বার্র্মিংহাম-সব ভলান্টিয়ার যেন এক আত্মা, এক প্রাণ।

কমনওয়েলথ গেমস বিশ্বের নানা দেশের, নানা বর্ণের, নানা ভাষার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। ইংরেজির পাশাপাশি অন্য ভাষাভাষী স্বেচ্ছাসেবীও রয়েছেন। কমনওয়েলথ গেমস সফল করতে ১৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে কাজ করছেন অনেক বাংলাদেশি। তাদেরই একজন নিগার সুলতানা পারভীন জলি। গেমসের প্রধান মিডিয়া সেন্টারে কাজ করছেন তিনি।

অ্যারেনা বার্মিংহামে বসে কথা হচ্ছিল জলির সঙ্গে, ‘৩০ হাজার মানুষকে স্বেচ্ছাসেবীর জন্য ডেকেছিল। সেখান থেকে ১৪ হাজার নেওয়া হয়। সেই দলের মধ্যে গেমসের মেইন মিডিয়া সেন্টারে ভলান্টিয়ার হিসাবে আমি একমাত্র নন ব্রিটিশ, বাংলাদেশি। মেইন মিডিয়া সেন্টারে প্রায় দুইশ সাংবাদিক কাজ করছেন। গেমসে রেজিস্ট্রেশন করেছেন ১৩০০ সাংবাদিক। আমি এখানে পিএইচডি করার জন্য গত বছর ফেব্রুয়ারিতে এসেছি। ২৪তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সহকারী অধ্যাপক। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ট্রেনিংয়ের অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর হিসাবে ছিলাম। বাংলাদেশ প্রাইম মিনিস্টার ফিলোশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামে এনভায়রনমেন্ট অব হেলথের ওপর পিএইচডি করছি।’ তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুরায়। তিনি যোগ করেন, ‘বাঙালি হিসাবে আলাদা কোনো ট্রিটমেন্ট তারা আমাকে দিচ্ছে, তা কিন্তু না। আমার কাছে এটা খুব সম্মানের এবং গর্বের। এখানে ব্রিটিশ, ইন্ডিয়ান, নাইজেরিয়ান, বিভিন্ন কালচারের লোকের সঙ্গে আমি মিশছি। সবাই খুবই ফ্রেন্ডলি।’ জলি বলে চলেন, ‘প্রথমদিন আমাদের যখন ট্রেনিং হচ্ছিল, তখন টিমের ডেপুটি হেড ম্যাথুউ বলছিলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে সাংবাদিকরা আসবেন। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি এখানে অন্য ভাষা জান, তাহলে তোমাদের ভাষার কেউ এলে তাকে একটু সাপোর্ট করার চেষ্টা করবে।’ জলির কথা, ‘ভলান্টিয়ার হিসাবে কী পাব, সেটা বড় কথা নয়। একজন বাংলাদেশি হিসাবে কমনওয়েলথ গেমসের মতো বড় আসরে ইংল্যান্ডে কাজ করছি, সেটা তো বড় প্রাপ্তি। এখানে ভলান্টিয়ারকে সবাই সম্মান দেয়।’ বলে চলছেন জলি, ‘বিভিন্ন দেশের লোকদের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়। আমাদের ফুড, রেসিপি, ক্রিকেট নিয়ে কথা বলেছি। আমাদের যে বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান রয়েছেন, সেটাও তাদের সঙ্গে শেয়ার করেছি। এগুলো তারা খুব ভালোভাবে নিয়েছে। আমার দেশের কক্সবাজার, সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের কথা বলেছি। চেষ্টা করি এগুলো সম্পর্কে মানুষকে জানাতে। পদ্মা সেতু নিয়ে আলাদা আগ্রহ রয়েছে ওদের।’

বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমস সফল করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ৭২ বছর বয়সি স্বেচ্ছাসেবী ম্যাথু ডোর। পেশায় অধ্যাপক ছিলেন। এখন অবসরে আছেন। দেশের জন্য কাজ করছেন। বিনিময়ে পাবেন শুধু একটি সনদপত্র। সেটা ব্রিটিশদের কাছে অনেক সম্মানের। স্বেচ্ছাসেবীরা যে সেবাই দিচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। মাঝেমধ্যে বিপদেও পরতে হয় তাদের। রোববার টেবিল টেনিস খেলা দেখতে গিয়ে রেলস্টেশনে জানতে চাইলাম ‘এনইসি হল থ্রি’তে কীভাবে যাব? কথাটা মজা করে বলেছিলাম বাংলায়। বিপদে পরল ভলান্টিয়ার মেয়েটি। ওকে সহযোগিতা করতে ৪/৫ জন ছুটে এলো। আমি কী বলছি তার একবিন্দুও বোঝার উপায় নেই তাদের। ওদের দুরবস্থা দেখে হাসছেন সহযাত্রী দুই সাংবাদিক। এরই মধ্যে একজন বলে উঠল ‘আপনি বাংলাদেশি?’ সাদা চামড়ার মানুষের মুখে বাংলা শুনে এবার আমার দুরবস্থা-পালাতে পারলেই যেন বাঁচি।

LEAVE A REPLY