অবৈধ স্বর্ণে বছরে পাচার ৭৩ হাজার কোটি টাকা : বাজুস

অবৈধভাবে দেশে স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। শনিবার (১৩ আগস্ট) সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান বাজুস নেতারা।  

সারা দেশে জুয়েলারি শিল্পের বাজারে অস্থিরতা, চলমান সংকট ও সমস্যা, দেশি-বিদেশি চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, অর্থপাচার ও চোরাচালান বন্ধ এবং কাস্টমসসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জোরালো অভিযানের দাবিতে এ সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) স্ট্যান্ডিং কমিটি অন অ্যান্টিস্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্ট। এতে বক্তারা বলেন, বাজুসের প্রাথমিক ধারণা- প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ত-ঘামে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যবহার করে প্রতিদিন সারা দেশের জল, স্থল ও আকাশপথে কমপক্ষে প্রায় ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সোনার অলংকার ও বার চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে।

যা ৩৬৫ দিন বা এক বছর শেষে দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। দেশে চলমান ডলার সংকটে এই ৭৩ হাজার কোটি টাকার অর্থপাচার ও চোরাচালান বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

বক্তারা বলেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির চরম আঘাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিপর্যস্ত। দেশে দেশে মার্কিন ডলারসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এরই প্রভাব পড়েছে সোনার বিশ্ব বাজারে। সাম্প্রতিক সময়ে অব্যাহতভাবে মার্কিন ডলারের মাত্রাতিরিক্ত দাম ও সংকটসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার ঊর্ধ্বমুখী দাম এবং বেপরোয়া চোরাচালানের ফলে বহুমুখী সংকটে পড়েছে দেশের জুয়েলারি শিল্প। দেশে মার্কিন ডলারের দাম ১১৮ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সোনার বাজারে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিয়েছে চোরাকারবারিদের দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিনিয়ত স্থানীয় পোদ্দার বা বুলিয়ন বাজারে সোনার দাম বাড়ানো হচ্ছে। পোদ্দারদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সোনার পাইকারি বাজার। পোদ্দারদের সঙ্গে চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মূলত এই চোরাকারবারিদের একাধিক সিন্ডিকেট বিদেশে সোনাপাচারের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করা হয়। দেশে চলমান ডলার সংকট ও অর্থপাচারের সঙ্গে সোনা চোরাচালানের সিন্ডিকেটগুলোর সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে সোনার বাজারে অস্থিরতার নেপথ্যে জড়িত চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে কাস্টমসসহ দেশের সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জোরালো অভিযান ও শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সোনার বাজারে শৃঙ্খলা আনতে কঠোর অভিযানের বিকল্প নেই।

বাজুস মনে করে, সারা দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও ব্যাবসায়িক সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কোনো দুষ্কৃতকারী, চোরাকারবারি যাতে দেশবিরোধী ও অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে সে লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে আসছে। অনেক চোরাকারবারিকে আইনের মুখোমুখি করা হয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ছে। অবৈধ উপায়ে কোনো চোরাকারবারি যেন সোনা বা অলংকার দেশে আনতে এবং বিদেশে পাচার করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সরকারের সব সংস্থাকে প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছি।  

এ ক্ষেত্রে বাজুসের প্রস্তাব হলো- সোনা চোরাকারবারিদের চিহ্নিত করতে বাজুসকে সম্পৃক্ত করে পৃথকভাবে সরকারি মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। পাশাপাশি চোরাকারবারিদের দমনে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে আরো কঠোর আইন করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনার বার ও অলঙ্কার আনার সুবিধা অপব্যবহারের কারণে ডলার সংকট ও চোরাচালানে কী প্রভাব পড়ছে, তা জানতে বাজুসকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরকে সমীক্ষা পরিচালনার প্রস্তাব করছি।  

বক্তারা আরো বলেন, আমাদের ধারণা- দেশে অবৈধভাবে আসা সোনার সিকি ভাগও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরে আসছে না। ফলে নিরাপদে দেশে আসছে চোরাচালানের বিপুল পরিমাণ সোনার চালান। আবার একইভাবে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ যে সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এটা কথার কথা নয়। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ লাভের জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিয়মিত কড়া নজরদারি প্রয়োজন। পাশাপাশি বাজুসকে সম্পৃক্ত করে আইন প্রয়োগকারী সব দপ্তরের সমন্বয়ে সোনা চোরাচালানবিরোধী সেল গঠন করতে হবে। এ ছাড়া চোরাচালান প্রতিরোধ করতে গিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের মাধ্যমে উদ্ধার হওয়া সোনার মোট পরিমাণের ২৫ শতাংশ সংস্থাগুলোর সদস্যদের মধ্যে পুরস্কার হিসেবে প্রদানের অনুরোধ করছি। মূলত চোরাচালান প্রতিরোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বাজুসের এই প্রস্তাবনা। বাজুসের এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে সোনা চোরাচালান প্রতিরোধ কার্যক্রম আরো বেগবান হবে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় কমবে।  

জুয়েলারি শিল্পের চলমান সংকট মোকাবেলায় বক্তারা বলেন, গয়নার মান উন্নয়নে হলমার্ক নীতিমালা ও ডায়মন্ড নীতিমালা প্রণয়নে সরকারের কাছে জোরালো দাবি জানাচ্ছে বাজুস। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন এন্টি স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্ট। আমরা বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন এন্টি স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্টের পক্ষ থেকে সোনা ও ডায়মন্ডের অবৈধ এবং অসাধু জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের উদ্দেশে স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই- হলমার্ক ব্যতীত কোনো অলংকার বিক্রয় করা যাবে না। যদি কোনো জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে হলমার্ককৃত অলংকার নিম্নমানের পাওয়া যায়, তাহলে যে প্রতিষ্ঠান ওই অলংকার হলমার্ক করেছে সে প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অবহিত করবে বাজুস। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সারা দেশে স্বর্ণের চারটি মান রয়েছে, যথাক্রমে ১৮, ২১, ২২ ও ২৪ (৯৯ দশমিক ৫)। এই মানের নিচে কোনো স্বর্ণ বা স্বর্ণালংকার বিক্রি করা যাবে না। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে তেজাবী (পাকা সোনা বা পিওর গোল্ড) স্বর্ণের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থায়ই ৯৯ দশমিক ৫-এর নিচে মান গ্রহণযোগ্য না। এ ক্ষেত্রে সব হলমার্কিং কম্পানিকে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী স্বর্ণ পরীক্ষা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।

LEAVE A REPLY