সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বড় বাধা বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামো

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে পর্বতপ্রমাণ বাধা হচ্ছে বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামো। এই বাধা দূর করতে কমিশনকে এখনই সুস্পষ্টভাবে সরকারকে বলতে হবে। বর্তমানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে না, নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে। এ ছাড়া দেশের জনসংখ্যার বিপুল একটা অংশ বাইরে থাকে।

তারাও ভোট দিতে পারে না। বিশ্বব্যাপী পোস্টাল ব্যালটের বিধান আছে। দেশেও এ ব্যবস্থা চালু করা দরকার।   

নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি সংসদ নির্বাচন আইন (আরপিও) সংশোধনের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছে। নির্বাচনে অনিয়মের প্রমাণ মিললে ভোটের ফল ঘোষণা হলেও তা গেজেট আকারে প্রকাশের আগ পর্যন্ত সেই ফল বাতিলের এবং পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ প্রদানের ক্ষমতা চেয়েছে কমিশন। কিন্তু নূর হোসেন বনাম নজরুল ইসলাম মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছেন। এ বিষয়ে আবারও ক্ষমতা পেতে আইন মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হওয়াটা আত্মঘাতীমূলক হতে পারে। মন্ত্রণালয় কমিশনের প্রস্তাবটি নাকচ করে দিতে পারে। উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন তার ক্ষমতার ব্যাপ্তি সম্পর্কে অবগত নয় বা উপলব্ধি করতে পারছে না। তা ছাড়া আরো কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব বিভ্রান্তিকর।

গতকাল শনিবার সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিশিষ্ট নাগরিকরা এসব কথা বলেন। সুজন সহসভাপতি বিচারপতি আবদুল মতিনের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনটির সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। অন্যান্যের মধ্যে স্থানীয় শাসন ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, সুজন সহসম্পাদক জাকির হোসেন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক, অধ্যাপক রুবাইয়াত ফেরদৌস, আকবর হোসেন, ফারুক মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচন কমিশনের অতুলনীয় ক্ষমতা রয়েছে। আর আমাদের সংবিধানে নির্বাচন মানেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। তাই যেনতেন প্রকারের বা কারচুপির নির্বাচন সাংবিধানিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। আর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামো নিঃসন্দেহে একটি পর্বতপ্রমাণ বাধা। ইসির দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচন করা। তারা যদি তা না করতে পারে তাহলে ইসির উচিত সরকার ও রাজনীতিবিদদের জানানো যে তারা কনস্টিটিউশনাল ম্যান্ডেটটা (সাংবিধানিক আদেশ) পূরণ করতে পারবে না। এটা যদি ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনের আগে বলতে পারত তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হতো। ’

তিনি বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পরপর দুটি ব্যর্থ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় সরকারের অধীনে সব নির্বাচন ছিল অগ্রহণযোগ্য।

বদিউল আলম আরো বলেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয়  সংসদ নির্বাচন কী প্রক্রিয়ায় হবে, তা ঠিক করতে রাজনৈতিক সমঝোতার বিকল্প নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। আমরা বহুদিন ধরে একটা জাতীয় সনদের কথা বলে আসছি।

অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে না। নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে। এ ছাড়া দেশের জনসংখ্যার বিপুল একটা অংশ বাইরে থাকে। তারাও ভোট দিতে পারে না। বিশ্বব্যাপী পোস্টাল ব্যালটের বিধান আছে। আমি মনে করি, পোস্টাল ব্যালটের সুযোগ করে দেওয়া উচিত। আরেকটি বিষয় হলো, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করার দায়িত্ব কমিশনের সাংবিধানিক ম্যান্ডেটের মধ্যে না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে কমিশন এই দায়িত্ব পালন করে আসছে। তাই স্থানীয় সরকার অনুষ্ঠানের দায়িত্ব কমিশনের ম্যান্ডেটের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া উচিত। ’

শাহদীন মালিক বলেন, ‘সংবিধানের ১১১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রায় মানা সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট যেটা বলেছেন সেটা এরই মধ্যে আইনে পরিণত হয়েছে। তাই কোর্টের রায়ে কমিশনকে নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হলেও তা আবার আইন সংশোধন করে সংযুক্ত করতে চাওয়ার উদ্দেশ্য কী তা প্রশ্নের উদ্রেক করে। তবে রায়ের বিষয়টি যাঁরা অবগত নন, তাঁদের অবগত করার জন্য অনেক সময় আইনে রায় সংযুক্ত করা হয়। ’

তিনি বলেন, ‘কমিশনের সংশোধনী প্রস্তাব আনার প্রক্রিয়াটিও আমার কাছে স্বচ্ছ মনে হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের সংলাপে যেসব প্রস্তাব এসেছে সেগুলোর একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত ও প্রকাশ করে অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে এই সংশোধনী প্রস্তাব করা উচিত ছিল। ’

বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে নির্বাচন বাতিলে কমিশনের ইনহেরেন্ট বা অন্তর্নিহিত ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে, তার পরও কমিশনের এই ক্ষমতা আবার চাওয়াটা সন্দেহের উদ্রেক করে বলে আমি মনে করি। ’

এদিকে লিখিত বক্তব্যে বদিউল আলম মজুমদার  নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংশোধনী প্রস্তাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে এমন কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেন এবং সংশোধনী প্রস্তাবে যুক্ত করার জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব রাখেন।

তিনি বলেন, আরপিও সংশোধনের লক্ষ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবটি অসম্পূর্ণ। এর একটি কারণ হলো, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কমিশনের সংলাপকালে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় না নেওয়া। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার ক্ষেত্রে আরো কিছু প্রস্তাব এতে যুক্ত করা প্রয়োজন। ‘না-ভোট’ পুনঃপ্রবর্তন; হলফনামার ছকে পরিবর্তন আনা এবং হলফনামায় নতুন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা; হলফনামায় মিথ্যা তথ্য প্রদান বা তথ্য গোপনকারীদের মনোনয়নপত্র বাতিলের সুস্পষ্ট বিধান আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা; হলফনামার তথ্য যাচাই-বাছাই করার বিধান আরপিওতে সংযুক্ত করা; প্রত্যেক প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব যাচাই-বাছাই করার বাধ্যবাধকতা আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা; নির্বাচনী ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থী ও ভোটারদের নিয়ে প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় একটি ‘জনগণের মুখোমুখি অনুষ্ঠান’ আয়োজন এবং হলফনামার তথ্য ছাপিয়ে তা ভোটারদের মধ্যে বিলি করার বিধান আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা; সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা ও আয়কর বিবরণী দাখিল করার বিধান আরপিওতে যুক্ত করা; রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সদস্যদের নাম ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও নিয়মিত আপডেট করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা; নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া রাজনৈতিক দলের অডিট করা হিসাব যাচাই-বাছাই করার বিধান আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা; বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা এবং এ লক্ষ্যে পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা করা; সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির দায়িত্ব জেলা জজদের ওপর ন্যস্ত করা এবং উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ রাখা; রিটার্নিং অফিসারের মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল নিষ্পত্তি করার সময়সীমা বর্তমানের তিন দিনের পরিবর্তে এক সপ্তাহ করা; স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া।

LEAVE A REPLY