আগামীর বলকান যুদ্ধক্ষেত্র হতে পারে ‘নতুন আর্কটিক’

প্রতীকী ছবি

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে উত্তর মেরু (সুমেরু বা আর্কটিক) অঞ্চলের বরফ গলে বিপুল সম্পদ ও অন্যান্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে বলে মনে করছেন অনেকে। ধীরে ধীরে রূপ নেবে এক ‘নিউ আর্কটিক’ বা নতুন সুমেরু।  

এ বিষয়গুলো বিশ্ব বাণিজ্য তথা অর্থনীতিতে বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রয়েছে সামরিক বিবেচনাও।

আর তাই ‘নিউ আর্কটিক’ ঘিরে চলছে এক নীরব প্রতিযোগিতা।

বিশেষজ্ঞরা তাই আর্কটিক ঘিরে নতুন এক আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের আভাস দিচ্ছেন। তারা মনে করছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন শক্তি ‘আগামীর সম্পদ’ দখলের জন্য লড়াই করতে উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলকে হয়তো আরেক বলকান অঞ্চল হওয়ার পথেই ঠেলে দিচ্ছে।

এ বিষয়ে প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড ফান্ড ফর নেচারের টম আর্নবম বলেন, ‘সম্পূর্ণ নতুন এক আর্কটিক অঞ্চলের দ্বার উন্মোচনের বিষয় এটি। ’

আর্কটিকের বরফ ক্রমবর্ধমান হারে গলে যাচ্ছে। জাতিসংঘের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ দল ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) মত অনুসারে, এই অঞ্চলে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশ্বের গড়ের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি দ্রুতগতিতে।  

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিষয়ক সংস্থা ইউএসজিএসের অনুমান, বিশ্বের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৩০ শতাংশ এবং সব তেলের প্রায় ১৩ শতাংশ আর্কটিক অঞ্চলে পাওয়া যাবে। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ সেখানে আছে।

‘সুতরাং আর্কটিকের প্রতিশব্দ হতে পারে ‘অঢেল সম্পদ’, মন্তব্য করেছেন সুইডেনের টোটাল ডিফেন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক নিকোলাস গ্রানহোম।  

আর্কটিক অঞ্চলের দেশগুলো হচ্ছে সুইডেন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড। এই দেশগুলো নিয়ে গঠন করা হয়েছে ‘আর্কটিক কাউন্সিল’। এই কাউন্সিল আর্কটিক অঞ্চলের যাবতীয় সমস্যা ও সমাধান নিয়ে কাজ করে।
 
আর্কটিকের বরফের আচ্ছাদন ক্রমে সংকুচিত হওয়ার কারণে বেশ কয়েকটি দেশ এই অঞ্চলের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা দাবি করতে চাইছে। এ নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে সীমানা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক অঞ্চলের একাধিক দাবিদার দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে কন্টিনেন্টাল-শেলফ কমিশনে অর্থনৈতিক জোনের আকার বাড়ানোর জন্য আবেদন জমা পড়েছে।
 
আর্কটিকের কোনো অঞ্চলের ওপর কার কতটুকু অধিকার আছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে অনেক জায়গায় সম্প্রসারিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য একাধিক দাবিদারের কথা এরই মধ্যে শোনা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া, কানাডা ও ডেনমার্ক- তিন দেশই এমন একটি অঞ্চলের ওপর অধিকার দাবি করছে, যার আয়তন প্রায় জার্মানির সমান। আর্কটিকে বর্তমানে এ ধরনের সাত বা আটটি সুস্পষ্ট বিরোধ রয়েছে। নরওয়ে এবং রাশিয়ার মধ্যে এমন একটি বিরোধ রয়েছে। রুশরা ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা নিষ্পত্তি নিয়ে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট নয়। তাই সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

গ্রিনল্যান্ডের সম্পদে সবার নজর
গ্রিনল্যান্ডে যে তেল, গ্যাস এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদ রয়েছে বলে এরই মধ্যে জানা গেছে, তা এক বিরল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। গ্রিনল্যান্ডের বর্তমান সরকার পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক মনে করায় এই মুহূর্তে খনি থেকে উত্তোলনের কাজ খুব বেশি করছে না। তবে ভবিষ্যতে দেশটির কোনো সরকার এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে গ্রিনল্যান্ড ‘আর্কটিক অঞ্চলের কাতারে’ পরিণত হতে পারে বলে মনে করছেন নিকোলাস গ্রানহোম।
 
২০০৯ সাল থেকে ডেনমার্কের কাছ থেকে বর্ধিত স্বায়ত্তশাসন পাওয়া দ্বীপটি অর্থনৈতিকভাবে ঘাটতিপূর্ণ এলাকা। পরিত্রাণের উপায় হিসেবে দ্বীপটিকে হয়তো একসময় বিস্তৃত প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণকেই বেছে নিতে হবে।  

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৯ সালে গ্রিনল্যান্ড কিনে নিতে চেয়েছিলেন, যেমন তারা অতীতকালে রাশিয়া কিনে নিয়েছিল তুষাররাজ্য আলাস্কা। চীনা কম্পানিগুলোও এরই মধ্যে গ্রিনল্যান্ডের খনিশিল্পে বিনিয়োগ করেছে। সে সুবাদে চীন নিজেকে একটি ‘নিয়ার আর্কটিক দেশ’ মনে করে, যা আর্কটিক অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর কেউই মেনে নেয় না।

বাণিজ্যে নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা
সম্পদ আহরণ করা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হলেও তা প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব কিনা এ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে শুধু প্রাকৃতিক সম্পদই নয়, আর্কটিকের প্রতি প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর আকর্ষণ বেড়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ বাণিজ্যিক সম্ভাবনা।
 
ধীরে ধীরে বরফ গলে যাওয়ার সাথে সাথে নৌপথে অবাধ বিচরণের দ্বার খুলে গেলে পণ্য পরিবহনের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে বহুগুণে। এশিয়ায় প্রবেশ করতে এমন একটি সংক্ষিপ্ত পরিবহন রুট তৈরি হবে, যা বহু দেশের অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল। অনেক শিপিং কম্পানি ইতিমধ্যে এই সম্ভাব্য রুটে গিয়ে সরেজমিনে পরীক্ষাও করেছে।  

তবে সুইডিশ শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যান্ডার্স হারম্যানসন মনে করেন, এই অঞ্চলে ব্যাপক নৌচলাচল দেখতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। এর কারণ হিসেবে তিনি সামুদ্রিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো ছাড়াও অপরিচিত আর্কটিক আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করেন।  

আর্কটিক অঞ্চলের সাগরে চলাচলরত জাহাজের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও এটি এখনও খুব নিম্ন স্তরে রয়েছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৯ থেকে আর্কটিকের মধ্য দিয়ে চলাচলকারী জাহাজের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৬২৮টি। পাশাপাশি একই বছর ব্যস্ত সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে যাওয়া জাহাজের সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৮৮০টি।

রয়েছে প্রতিরক্ষার দিকও
আর্কটিক অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সামরিক বিষয়টিও। কোলা উপদ্বীপে রয়েছে রাশিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের দ্বিতীয় প্রধান কেন্দ্র। ‘এর মানে হলো, আমাদের নিকটবর্তী এলাকায় রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদী, কেন্দ্রীয় এবং অস্তিত্বের স্বার্থ রয়েছে’, বলেন নিকোলাস গ্রানহোম। ‘

বিষয়টি রাশিয়ার রাজনৈতিক বিবেচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকায় দেশটি তার সামরিক উপস্থিতি আরো পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে নিয়ে যেতে পারে। সেখানে আটলান্টিকের গুরুত্বপূর্ণ নৌচলাচল ও টেলিযোগাযোগ পথ লক্ষ্য করে রাশিয়া হুমকিমূলক প্রচেষ্টা চালাতে পারে। রাশিয়া পশ্চিমা নৌ ও বিমান বাহিনীকে যতটা সম্ভব ব্যারেন্টস সাগর থেকে দূরে রাখতে চায়। সেই সাথে তাঁরা যদি আটলান্টিকের নৌপথে জাহাজচলাচল ও টেলিযোগাযোগ ব্যাহত করতে সক্ষম হয়, তাহলে অনেকাংশেই জিতে যাবে।  

যুক্তরাষ্ট্রও বসে নেই। আর্কটিক ঘিরে তারাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। নতুন পোতাশ্রয় এবং আইসব্রেকার তৈরি করছে। রাডার স্টেশনগুলোর আধুনিকায়নসহ জোরেশোরে প্রতিরক্ষামূলক তৎপরতা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০০৭ সাল থেকে আর্কটিক নিয়ে তাদের গবেষণা আরো সমৃদ্ধ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রতিরক্ষা শাখা এই অঞ্চলের জন্য তাদের নিজস্ব কৌশলও তৈরি করেছে।  

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের টম আর্নবমের ধারণা, বিদ্যমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্ট স্বার্থগুলো আর্কটিক এলাকার একটি মৌলিক পরিবর্তন আনবে। বিশ্ব একটি নতুন আর্কটিক পাবে। তার মতে, এ পরিবর্তনকে ঠেকানোও সম্ভব নয়। তবে অনাকাঙ্খিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে এবং একটি ইতিবাচক আর্কটিকের জন্য সর্বসম্মত শর্তের আওতায় আসতে হবে। ‘ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, এ ধরনের পরিবর্তন প্রায়ই অপ্রত্যাশিত, ব্যয়বহুল এবং কখনো কখনো খুব রক্তক্ষয়ী হয়’, বলেন টম আর্নবম।

LEAVE A REPLY