ঘুস দিতে হয় ২৯ শতাংশ পোশাক কারখানাকে

পোশাক কারখানা পরিদর্শনের নামে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডাইফি) কর্মকর্তাদের ঘুস দিতে হয়।

অন্তত ২৯ শতাংশ কারখানা এ ধরনের ঘুসের শিকার হয়। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জরিপে।

২০২১ সালে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডাইফি) তৈরি পোশাক কারখানায় গড়ে দুদফা পরিদর্শন করে। এ সময় ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ কারখানাকে ডাইফির পরিদর্শকদের বাড়তি অর্থ ঘুস হিসাবে দিতে হয়।

সিপিডি ৫১টি পোশাক কারখানার এক হাজার ২৪৪ জন শ্রমিকের ওপর এই জরিপ চালায়। এতে অংশ নেয় ৬০ শতাংশ নারী আর ৪০ শতাংশ পুরুষ শ্রমিক। জরিপের ফলাফল বুধবার রাজধানী মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘তৈরি পোশাক খাতের সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধি’ শীর্ষক সংলাপে উপস্থাপন করা হয়। সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সিপিডি এবং ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ যৌথভাবে সংলাপের আয়োজন করে।

মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, করোনাপরবর্তী সময়ে তৈরি পোশাক খাতে উচ্চ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হ?য়ে?ছে। তবে ওই সময় গড়ে ১৮ দশমিক ১ শতাংশ শ্রমিককে জোরপূর্বক কাজ করানো হয়েছে। যেখানে পুরুষ শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি ছিল।

শ্রমিকদের ৭৪ দশমিক ৩ শতাংশ করোনার টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন। দ্বিতীয় ডোজ নিচ্ছেন মাত্র ২০ শতাংশ শ্রমিক, যাদের ওপর জরিপ করা হয় তারা কেউ বুস্টার ডোজ নেননি। টিকা নিতে ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগায় শ্রমিকরা আগ্রহী হন না। এছাড়াও গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪২ শতাংশ কারখানা কোনো নিয়মের মধ্যে নেই। ৪৫ শতাংশ কারখানা ভাড়ায় চলে। ২৫ শতাংশ কারখানার সার্টিফিকেটে নেই।

মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, পোশাক খাতে আগের তুলনায় কর্মহীনের সংখ্যা কমে এসেছে। তা সত্তে¡ও কারখানাগুলোতে গড়ে ৪০ জন শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। আশঙ্কার বিষয় হলো, নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমছে। আবার এখনো অনেক কারখানায় শ্রম অধিকার মানা হচ্ছে না। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, শ্রমিকের আয়ের তুলনায় ব্যয় সাড়ে নয় শতাংশ বেড়েছে। ব্যয় সামলাতে শ্রমিকরা এখন আগের থেকে বেশি কাজ করছে। নারী শ্রমিকের প্রতি যৌন হয়রানি কমেছে, তবে সাম্প্রতিক সময় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কারখানাগুলোতে বেড়েছে, যার অধিকাংশই সাব কন্ট্রাক্ট কারখানা।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) খালেদ মামুন চৌধুরী, বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহিদুল­াহ আজিম, গার্মেন্টস ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কারস সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার প্রমুখ।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে শ্রমিকরা চরম সংকটে রয়েছে উলে­খ করে গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি অ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ বলেন, একজন শ্রমিক আট ঘণ্টার জায়গায় ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করছে। হাড়ভাঙা কাজের চাপ নিয়ে ইতোমধ্যে কেউ কেউ মারাও গেছে। অথচ মালিকরা মনে করেন শ্রমিকরা ভালো আছে। আবার এই সংকট সমাধানে সরকারপ্রধান অভিভাবক হলেও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। চার বছর আগের মজুরি দিয়ে আজকের এই সময়ে সেই মজুরি শ্রমিকের বেঁচে থাকার জন্য কতটা কার্যকর সেটি বিবেচনা করা হচ্ছে না।

শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তার দাবি করেন, দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, সঙ্গে শ্রমিকদের বেঁচে থাকার কষ্ট আরও বেড়েছে। সুসংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন না থাকায় মজুরি বৃদ্ধির দাবিটি শ্রমিকরা জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারছে না। তাদের মাঝে চাকরি হারানোর ভয়ও কাজ করে।

এর জবাবে নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকার সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ট্রেড ইউনিয়নে সাধারণ শ্রমিকরা আগ্রহী নন। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হচ্ছে না এই দাবিও সঠিক নয়। এ সময় দেশের স্বার্থে শ্রমিক নেতাদের বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি অযথা নষ্ট না করারও আহ্বান জানান তিনি।

তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুল­াহ আজিম বলেন, দেশে এখন এক হাজার ১৩৬ ইউনিয়ন আছে। ফলে ইউনিয়ন করতে দেওয়া হচ্ছে না, এমন দাবি সঠিক নয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, অন্যান্য পরিবারের মতো পোশাক শ্রমিকরা যেন টিসিবির পণ্য পায় সে বিষয়ে চিন্তা করা হচ্ছে। কারখানার কাজের উন্নয়নে ট্রেড ইউনিয়ন থাকা উচিত। তবে ট্রেড ইউনিয়নকে শ্রমিকদের স্বার্থ যেমন দেখতে হবে, তেমনই কারখানাও টিকিয়ে রাখতে হবে। কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের সমন্বয়ে ট্রেড ইউনিয়নের প্রধান কাজ হতে হবে। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি কারখানা টিকিয়ে রাখার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে শ্রমিক নেতাদের।

LEAVE A REPLY