‘বিচারক মননে স্বাধীন না হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রায় অসম্ভব’

মননে, চলনে, বিশ্বাসে সহকর্মীদের স্বাধীন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আপিল বিভাগের বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বলেছেন, তা না হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রায় অসম্ভব। আজ বৃহস্পতিবার বিদায়ি অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন সর্বোচ্চ আদালতের তৃতীয় এই নারী বিচারক।

সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত বয়স ৬৭ বছর পূর্ণ হলে বিচারকদের অবসরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুযায়ী তাঁর অবসরের বয়স আগামী ৯ অক্টোবর।

বিজ্ঞাপনকিন্তু অবকাশ, সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটি মিলিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নিয়মিত বিচারকাজ আগামী দেড় মাস বন্ধ থাকবে। সর্বোচ্চ আদালত নিয়মিত বিচারকাজে ফিরবে ১৬ অক্টোবর। সে হিসাবে বৃহস্পতিবারই বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের শেষ কর্মদিবস। এর মধ্য দিয়ে তাঁর ৪১ বছরের বেশি সময়ের বিচারিক জীবনের ইতি ঘটল।

তাঁর বিদায় উপলক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়। আপিল বিভাগের ১ নম্বর এজলাসকক্ষে আয়োজন করা হয় বিদায় অনুষ্ঠানের। অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, আপিল বিভাগের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ফকির, সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা ও আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিদায়ি এই বিচারকের কর্মজীবনের নানা দিক তুলে ধরা হয়। পরে বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ফকির। এরপর লিখিত বক্তব্যে বিদায়ি ভাষণ দেন বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ।

পেশাগত জীবনে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মীদের ভূমিকা, সহযোগিতার কথা স্মরণ করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান সর্বোচ্চ আদালতের তৃতীয় এই নারী বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘আমার এই বিচারিক জীবনে এ বিশ্বাসে আমি উপনীত হয়েছি যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাগজে-কলমে নিরঙ্কুশভাবে বাস্তবায়ন হলেও একজন বিচারক যদি তার মননে, চলনে, বিশ্বাসে নিজেকে স্বাধীন মনে না করে তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদূর পরাহত। ’

তিনি বলেন, ‘একজন বিচারক বিচারকাজে সম্পূর্ণ স্বাধীন―এই মূলমন্ত্র ধারণ করেই বিচারকাজ সম্পন্ন করবেন আর আপনারা অর্থাৎ বিজ্ঞ আইনজীবীগণ সে কাজে সহযোগিতা করবেন। ’

কৃষ্ণা দেবনাথের জন্ম ১৯৫৫ সালের ১০ অক্টোবর। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার পুড্ডায় কৃষ্ণা দেবনাথের বাড়ি হলেও বাবা দীনেশ চন্দ্র দেবনাথের কর্মস্থল রাজবাড়ী মুনসেফ কোয়ার্টারে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর মা বেনু দেবনাথ। দুই ভাই ও আরো দুই বোনের সঙ্গে রাজবাড়ীতেই কাটে শৈশব। বাবার চাকরির সুবাদে ১৯৭০ সালে সিলেট গার্লস স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন (মাধ্যমিক) পাস করেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন। রংপুর বেগম রোকেয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি জুর (আইনে স্নাতক) ও এম জুর (আইনে স্নাতকোত্তর) পাস করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে রাজশাহী জেলা আইন সমিতিতে আইন পেশা শুরু করেন। বছরখানেক আইন পেশায় নিয়োজিত থাকার পর ১৯৮১ সালের ৮ ডিসেম্বর জুডিশিয়াল সার্ভিসে মুনসেফ (বর্তমান সহকারী জজ) হিসেবে নিয়োগ পান কৃষ্ণা দেবনাথ।  

ওই বছরই তিনি বিয়ে করেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী স্বপন দত্তকে। ১৯৯২ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে সাবজজ থেকে অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে তাঁর পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভায় পরপর তিনবার তাঁকে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। পদোন্নতির তালিকার শীর্ষে ছিল তাঁর নাম। তার পরও পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। এরপর ১৯৯৪ সালে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের হস্তক্ষেপে ওই বছরই কৃষ্ণা দেবনাথকে অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।  

১৯৯৮ সালে জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। বিভিন্ন জেলায় জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পান কৃষ্ণা দেবনাথ। তিনিই ঢাকা জেলার প্রথম নারী জেলা জজ। এই দায়িত্ব পালনকালে ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল তাঁর নিয়োগ স্থায়ী হয়। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন কৃষ্ণা দেবনাথ। আপিল বিভাগের তিনি তৃতীয় নারী বিচারপতি।  

LEAVE A REPLY