চলতি বছরে প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসা, নার্সিং প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী রয়েছেন। আজ শুক্রবার সকাল ১০ টায় “বেড়েই চলেছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ; আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া কতটা জরুরী? – শীর্ষক সমীক্ষা” বিষয়ক এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানায় সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশের দেড়শত জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল থেকে আত্মহত্যার সংবাদ বিশ্লেষণ করে এই তথ্য উপস্থাপন করে সংগঠনটি।
সমীক্ষা অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে ৩৬৪ জন আত্মহত্যা করে যারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছিলেন। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসা, নার্সিং প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী রয়েছেন। ৩৬৪ জন আত্মহত্যাকারীর মধ্যে স্কুলের শিক্ষার্থী ১৯৪ জন, কলেজের শিক্ষার্থী ৭৬ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৫০ জন, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ৪৪ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থী ৬০.০০ শতাংশ, নারী শিক্ষার্থী ৪০.০০ শতাংশ। কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪৬.০৫ শতাংশ পুরুষ, ৫৩.৯৫ শতাংশ নারী। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩২.৯৯ শতাংশ পুরুষ, ৬৭.০১ শতাংশ নারী। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের তাদের মধ্যে ৩৯.২৯ শতাংশ পুরুষ, ৬০.৭১ শতাংশ নারী।
এছাড়া সমীক্ষা অনুযায়ী আত্মহত্যায় এগিয়ে আছে নারী শিক্ষার্থীরা যা মোট আত্মহননকারীদের ৬০.৭১ শতাংশ বা ২২১ জন। অন্যদিকে পুরুষ শিক্ষার্থী রয়েছেন ৩৯.২৯ শতাংশ বা ১৪৩ জন। বিভাগ অনুযায়ী আত্মহত্যাকারীদের অবস্থান বিবেচনায় সবার শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা ও সর্বনিম্নে সিলেট।
আত্মহননকারীদের মধ্যে ঢাকায় গত ৮ মাসে শতকরা ২৫.২৭ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১৬.৪৮ শতাংশ, খুলনায় ১৪.০১ শতাংশ, রংপুরে ৮.৭৮ শতাংশ, বরিশালে ৯.৬২ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৭.৪২ শতাংশ, রাজশাহীতে ১৪.০১ শতাংশ ও সিলেটে ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্নহত্যা করেছেন।
সমীক্ষা অনুযায়ী আত্মহত্যা কারণের মধ্যে রয়েছে অভিমান, প্রেমঘটিত কারণ, সেশনজট, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, চুরি বা মিথ্যা অপবাদ, মানসিক সমস্যা, বিয়েতে প্রত্যাখ্যাত, স্বামী পছন্দ না হওয়া, বাসা থেকে মোটরবাইক কিনে না দেওয়া ইত্যাদি। এর মধ্যে প্রেমঘটিত কারণে ২৫.২৭ শতাংশ , অভিমান করে ২৪.৭৩ শতাংশ, পরিবারের সাথে চাওয়া পাওয়ার অমিল হওয়ায় ৭.৪২ শতাংশ, পারিবারিক কলহের কারণে ৬.৫৯ শতাংশ, ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির কারণে ৪.৬৭ শতাংশ, মানসিক সমস্যার কারণে ৬.৫৯ শতাংশ, পড়াশোনার চাপে ০.৮২ শতাংশ , সেশনজটের কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ০.৮২ শতাংশ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ১.৯২ শতাংশ, চুরির মিথ্যা অপবাদে ১.৬৫ শতাংশ, আর্থিক সমস্যায় ১.৯২ শতাংশ, বন্ধুর মৃত্যুতে বিষাদগ্রস্ত হয়ে ০.৫৫ শতাংশ, বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এবং স্বামী পছন্দ না হওয়ায় ১.১০ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তবে ১৫.৯৩ শতাংশের আত্মহননের কারণ জানা যায়নি বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন , বর্তমানে আত্মহত্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বিশেষ করে কম বয়সী স্কুলগামী থেকে তরুণ প্রজন্মদের মাঝে এই প্রবণতা বেশি। এই হার এতো উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে কোন কারণগুলো আছে তা খুঁজে বের করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবী । অন্যথায় শিক্ষার্থীরা এখন যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে আত্মহত্যা না করলেও তাদের অন্যান্য মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। পেশাজীবীদেরও এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা উচিত এবং কী পদক্ষেপ নেয়া যায় সে বিষয়ে সমন্বিত কাজ করা প্রয়োজন।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, আমাদের শুরুতেই অনুধাবন করতে হবে যে এই সংকট করোনার চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ৩৬৪ জনের আত্মহত্যা অনেক বড় একটি সংখ্যা। তাই এটিকে সংকট হিসেবে আখ্যা দিয়ে সরকার, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিসহ প্রতিটা স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ জরুরী। সবাই যার যার জায়গা থেকে সচেতন হলে এ সমস্যা সহজেই মোকাবেলা করা সম্ভবপর হবে।
এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ১০ টি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। এগুলো হলো: আত্মহত্যা মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন; পাঠ্যপুস্তকে মানসিক শিক্ষাকে এবং মনের যত্নের কৌশলগুলোকে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা; স্কুল – কলেজের অভিভাবক সমাবেশের আলোচিত সূচিতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা সম্পর্কিত এজেন্ডা রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা প্রদান; সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা; প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদেরকে প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রদান; সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা; মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা; হতাশা , আপত্তিকর ছবি , আত্মহত্যার লাইভ স্ট্রিমিং , জীবননাশের পোস্ট ইত্যাদি চিহ্নিত করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ টুলস ব্যবহার করা; আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবার ও পরিচিতজনদের দায় অনুসন্ধানে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা; মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে একটি টোল ফ্রি জাতীয় হট লাইন নম্বর চালু করা।