বেশি মুনাফার আশায় জিরার সঙ্গে মেশানো হচ্ছে ক্যারাওয়ে সিড। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা ক্যারাওয়ে সিড দেখতে জিরার মতোই। সাধারণ মানুষের পক্ষে দেখে চেনার উপায় নেই এটি আসল না নকল জিরা। তবে ঘ্রাণ শুঁকে এবং মুখে নিয়ে বোঝা যায় এটি জিরা নয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্যারাওয়ে সিড মসলাজাতীয় পণ্য না হলেও শুধু শুল্কহার ও দামের পার্থক্যের কারণে আমদানীকৃত জিরার সঙ্গে দেশেই মেশানো হচ্ছে এগুলো। এতে কেজিতে অন্তত ১৫০ টাকা বেশি মুনাফা করছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের লেকচারার মোরশেদ এম খন্দকার গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্যারাওয়ে ও জিরা দেখতে কিছুটা একই রকম হলেও স্বাদ ও গুণাগুণ ভিন্ন। ক্যারাওয়েতে যষ্টিমধু ও সিট্রাসজাতীয় ফলের স্বাদ পাওয়া যায়। কারি, স্যুপ ও সসেজ তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। কেক তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। সাধারণ মানুষের জন্য ক্যারাওয়ে নিরাপদ। তবে শিশু, অন্তঃসত্ত্বা, দুগ্ধদানকারী নারী এবং লিভার ও গলব্লাডারের রোগীদের এটি এড়িয়ে চলা উচিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত ওষুধ কম্পানি, বিশেষ করে ভেষজ ওষুধ তৈরির জন্যই এ পণ্যটি আমদানি শুরু করে একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। এর পর থেকে সেটি বাণিজ্যিকভাবে আমদানি শুরু হয়। এই সিড আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা বা বিশেষ কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজনও নেই। জিরা ও ক্যারাওয়ে সিড আমদানিতে একই ধরনের অনুমতির প্রয়োজন হয়। ক্যারাওয়ে সিড আমদানিতে কাস্টমসে ৩৫ শতাংশ শুল্কহার প্রযোজ্য। ফলে প্রতি কেজিতে শুল্ক দিতে হয় মাত্র ২০ টাকা। আর জিরা আমদানিতে ৬১ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। প্রতি কেজিতে শুল্ক দিতে হয় ১১০ টাকা। শুল্কহার এবং শুল্কায়ন মূল্যের বৈষম্যের কারণে প্রকৃত জিরা আমদানিকারকরা ব্যবসায় টিকতে পারছেন না।
জানতে চাইলে মসলা আমদানিকারক ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি গত রোজার ঈদের পর থেকে জিরা আমদানি করছি না। এখন ভারতের বাজারে প্রতি টন জিরার বুকিং তিন হাজার ২০০ ডলার। সেই দামে জিরা এনে দেশে বিক্রি করতে হবে কেজি ৪০০ টাকার ওপর; কিন্তু ক্যারাওয়ে মেশানো জিরা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা কেজিতে। ফলে প্রতিযোগিতা, কস্টিং এবং আন্তর্জাতিক দর কোনো কিছুই সামঞ্জস্য নেই। ’
জিরা আমদানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এস হোসাইন অ্যান্ড কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালাহ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, আগে ইরান, আফগানিস্তান, তুরস্ক থেকে জিরা আমদানি হতো চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এখন স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে চোরাপথে আসছে এই জিরা। এতে কারণে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জিরা আমদানি কমেছে। আর ক্যারাওয়ে আসছে মিসর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। জিরার সঙ্গে ক্যারাওয়ে মেশানোর কারণে কেজিতে ব্যবসায়ীদের মুনাফা অন্তত ১৫০ টাকা। ফলে সুযোগ লুফে নিতেই এই অনিয়ম।
জানতে চাইলে মসলাপণ্য আমদানিকারক অসীম এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অসীম কুমার দাশ কালের কণ্ঠকে বলেন, বনেদি মসলা ব্যবসায়ীরা এখন মসলা আমদানির হাল ছেড়ে দিয়েছেন। শুল্কহারে অসম প্রতিযোগিতার কারণে প্রকৃত ব্যবসায় ধস নেমেছে, আমদানি কমেছে। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমছে। ’
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে একটি অংশে বিক্রি হয় মসলাজাতীয় পণ্য। আগে ক্যারাওয়ে সিড প্রকাশ্যে দোকানে বিক্রি হলেও এখন তা হয় না। মূলত কয়েক বছর আগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা লুকিয়ে সেগুলো বিক্রি করছেন। গতকাল বিকেলে খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইয়ের অন্তত ১০টি আড়ত ঘুরেও ক্যারওয়ে সিড পাওয়া যায়নি।
ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা করতে কাজ করে সরকারের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক ফয়েজ উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই ধরনের প্রতারণার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যদি কেউ আমাদের দেয়, তাহলে অবশ্যই ভোক্তাদের স্বার্থে আমরা পদক্ষেপ নেব। ’