দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স। এ দুই খাতে আয় বাড়ছে। এদিকে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা কমতে শুরু করেছে। এরপরও আমদানি ব্যয় কমেনি। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির পরিবর্তে কমে যাচ্ছে। রিজার্ভ কমে গত রোববার ৩৬৮৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। করোনার সময় স্থগিত এলসির দেনা ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।
জানা গেছে, গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স খাতে আয় হয়েছে ২১০৩ কোটি ডলার। রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৫২০৮ কোটি ডলার। এই দুই খাতে ৭৩১১ কোটি ডলার আয় হয়। একই অর্থবছরে আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৮২৫০ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে ৯৩৩ কোটি ডলার। বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে পরিশোধ হচ্ছে। এর বাইরে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাবদ গত অর্থবছরে এসেছে ২১৮ কোটি ডলার। একই সময়ে বিদেশে চিকিৎসা, ভ্রমণ ও পড়াশোনায় এর চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। সব মিলে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। এ কারণে ডলারের সংকটও প্রকট হচ্ছে।
আগে রপ্তানি আয় দিয়ে ৬০ শতাংশ আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। বাকি ৪০ শতাংশ আমদানি ব্যয় মেটানো হতো রেমিট্যান্স দিয়ে। এই ব্যয় মিটিয়ে আরও কিছু ডলার থেকে যেত। সেগুলো রিজার্ভে যোগ হয়েছে। গত বছরের আগস্ট থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম হু-হু করে বাড়া ও রেমিট্যান্স কমার কারণে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স দিয়েও আমদানি ব্যয় পুরোপুরি মেটানো যাচ্ছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ফলে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে সংকট আরও প্রকট হয়।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রধান সংকট হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে গেছে, ব্যয় বেড়ে গেছে। এখন এই সংকট মোকাবিলা করতে দুটি পদক্ষেপ নিতে হবে। এক. বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমাতে হবে এবং দুই. বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়াতে হবে। অথবা একই সঙ্গে দুটি নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেদিকেই হাঁটছে। বিধিনিষেধ আরোপের ফলে এখন আমদানি কমছে। কিন্তু আগের স্থগিত এলসির দেনাগুলো এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ কারণে রিজার্ভে চাপ বেশি। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে গেলে রিজার্ভে চাপও কমবে।
সূত্র জানায়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস এখন রপ্তানি খাত। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট এই দুই মাসে এ খাতে আয় বেড়েছে ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত অর্থবছরে বেড়েছিল ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ গত অর্থবছরে কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট এই দুই মাসে বেড়েছে ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ।
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের প্রধান খাত আমদানিতে গত মে থেকে এলসি খোলার হার কমতে শুরু করেছে। ওই সময় থেকে আমদানি খাতে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপিত হওয়া এবং ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা কমেছে। যে কারণে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই আগস্টের দেনা কমে ১৭৬ কোটি ডলার হয়েছে। এর আগের দুই মাসে অর্থাৎ মে-জুনে এ খাতে ১৯৬ কোটি ডলার এবং মার্চ-এপ্রিলে ২০৯ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। আমদানি কমায় এ খাতে দেনাও কমেছে। তবে সার্বিক আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে বেড়েছে ২৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। গত জুলাই-আগস্টে এলসি খোলা প্রবৃদ্ধি কমে ১০ শতাংশ হয়েছে। আগে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৪ শতাংশ।
সূত্র জানায়, গত মে থেকে এলসি খোলার হার কমলেও করোনার সময় গত ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালের শুরুর দিকে অনেক এলসির দেনা পরিশোধ স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে অনেক বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধও স্থগিত ছিল। বিশেষ করে ৩ থেকে দুই বছর মেয়াদে ওইসব দেনা পরিশোধ স্থগিত করা হয়। এখন ওইসব দেনা পরিশোধ করতে হচ্ছে। যে কারণে সার্বিকভাবে আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে। এছাড়া বৈদেশিক ঋণের কিস্তিও এখন পরিশোধ করা হচ্ছে। এসব মিলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় বেড়ে গেছে।