সমালোচনা সত্ত্বেও ইভিএম ব্র্যান্ডিংয়ে তৎপর ইসি

বিভিন্ন মহলের সমালোচনা সত্ত্বেও ইভিএম ব্র্যান্ডিং নিয়ে কৌশলি প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মাধ্যমে মেশিনে ভোট নিয়ে সমাজের নানা পর্যায়ে যে নেতিবাচক ধারণা আছে, তা পালটে দিতে চাচ্ছে ইসি। এর আওতায় নেতিবাচক দিকগুলো ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে ব্যবহার করা হবে ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটারদের। জনপ্রিয় ব্যক্তিদের মাধ্যমেও নেতিবাচক দিকগুলোর বিশ্লেষণ করে সবার সামনে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হবে। এছাড়া প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহণ ও জনসমাগম হয় এমন স্থানে প্রচার চলানো হবে। ইভিএম ব্র্যান্ডিং করতে ব্যবহার করা হবে জনপ্রিয় ক্রিকেটার, অভিনেতা ও কণ্ঠশিল্পীদের। আয়োজন করা হবে টকশো। তৈরি করা হবে থিম সং ও র‌্যাপ সং। বিদ্যমান দেড় লাখ ইভিএম ক্রয়সংক্রান্ত প্রকল্প ও দুই লাখ ইভিএম কেনার প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্পের আওতায় এসব করা হবে। ধারাবাহিকভাবে এ প্রচারণা চলবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত। সোমবার নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত ইসির অষ্টম সভায় ইভিএম নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানোর এ সিদ্ধান্ত হয়। তবে এ কাজে কত টাকা ব্যয় হবে, তা ওই সভায় উল্লেখ করা হয়নি। বৈঠকের কার্যপত্র পর্যালোচনা এবং অংশ নেওয়া কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

নির্বাচন কর্মকর্তার আঙুলের ছাপে কত শতাংশ ভোটার তাদের ভোট দিতে পারবেন, সেই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি ইসি। কমিশন সভায় নির্বাচন কর্মকর্তাদের আঙুলের ছাপে এক শতাংশ ভোটারের ব্যালট ইস্যু নির্দিষ্ট করে দিতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ আরপিওর ২৬ ধারায় একটি সংশোধনী আনার প্রস্তাব তোলা হয়। নির্বাচন কমিশনারদের ভিন্নমতের কারণে ওই সংশোধনী এজেন্ডা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

সূত্রমতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ দেড়শ আসনে ইভিএম ব্যবহার করে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত রয়েছে ইসির। এ লক্ষ্যে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ লাখ ইভিএম কিনতে একটি প্রকল্প প্রস্তাব সম্প্রতি অনুমোদন করে কমিশন। গত নির্বাচনের আগেও ইসি দেড় লাখ ইভিএম কিনেছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মহলের ব্যাপক আপত্তি রয়েছে। এমনকি ইভিএমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগও রয়েছে তাদের। যদিও ইসি দাবি করছে, এখন পর্যন্ত ইভিএমে কারচুপির প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচারে নামতে যাচ্ছে ইসি। আসন্ন গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে সুসজ্জিত বাহন ও বাউল দলের মাধ্যমেও প্রচারণার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রসঙ্গত আগামী ১২ অক্টোবর এ আসেন ইভিএমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে কমিশনের এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় চারজন নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেন। প্রায় দুই ঘণ্টা চলে এ বৈঠক। এরপর ফরিদপুর-২ আসনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইভিএম নিয়ে এত ব্যাপক প্রচার কখনো চালানো হয়নি। এবারও প্রথম বড় আকারের এ প্রচার চালাতে যাচ্ছে ইসি। প্রচারের ব্যয় চলমান ও প্রস্তাবিত প্রকল্প থেকে বহন করা হবে।

ইভিএম নিয়ে প্রচারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন, ফেসবুকে প্রচার করা হবে। পত্রপত্রিকা, মসজিদ-মন্দির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইভিএম নিয়ে প্রচার করা হবে। এটি একটি সমন্বিত কর্মসূচি। এজন্য আমরা ইভিএম প্রকল্পের পরিচালককে কর্মপরিকল্পনা তৈরির দায়িত্ব দিয়েছি। অল্প সময়ের মধ্যে কমিশনকে তিনি একটি কর্মপরিকল্পনা দেখাবেন।

এরপর এটি আমরা প্রচারের ব্যবস্থা করব। তিনি বলেন, জনগণ যাতে ইভিএম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পায় এবং কিভাবে ভোট দেবে, এটি প্রচারিত হয় এজন্য তারা কাজ করবেন।

ইসি সচিব বলেন, অনেকের এই ধারণা থাকে যে আমি কলা মার্কায় ভোট দিতে চাই, বাটনে টিপ দিলে ভোট কলা মার্কায় না গিয়ে আম মার্কায় চলে যেতে পারে। এরকম ধারণা জনগণের মাঝে বা কারও মধ্যে থাকতে পারে। এই ধারণাগুলো দূর করার জন্য যত সন্দেহ আছে, সেগুলো প্রশ্নাবলি আকারে একটা টিভিসি তৈরি করা হবে। আমরা এটি প্রচার করব। তবে ইভিএম নিয়ে কী ধরনের নেতিবাচক প্রচার রয়েছে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হননি ইসি সচিব। বৈঠক সূত্র জানায়, সভায় ইভিএম নিয়ে প্রচার চালানোর কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন চলমান দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান। এতে তিনি ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ইভিএমের পক্ষে যেসব প্রচার চালানো হয়েছে, তা উল্লেখ করেন। চলতি অর্থবছরে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কখন কী ধরনের প্রচার চালানো হবে, তারও কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে নতুন দুই লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত প্রচারণামূলক কাজের কৌশল, পদ্ধতি ও চ্যালেঞ্জও ইসির সামনে উপস্থাপন করেন।

নতুন প্রকল্পের আওতায় যেসব প্রচার : ইসি ৮৭১১ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই লাখ ইভিএম কেনার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। ওই প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে নভেম্বর থেকে এর কার্যক্রম শুরু হবে। নতুন প্রকল্পের আওতায় অন্তত ২৫ ধরনের কৌশলে প্রচার চালানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইভিএম ফ্লোর গেম ও অ্যাপস তৈরি। ১৫০টি আসনে ৫ হাজার স্কুলে ফ্লোর গেম বিতরণ করা হবে। খ্যাতনামা অভিনেতাদের নিয়ে ইভিএম-সংক্রান্ত ভিডিও নির্মাণ করে তা প্রচার করা হবে। ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটারদের দিয়ে ইভিএমের নেতিবাচক দিকগুলো ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন জনপ্রিয় ভিডিওর বিরতিতে ইভিএম সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন প্রচার করা হবে। ইভিএম সংক্রান্ত টকশোর আয়োজন করা হবে। জনপ্রিয় শিল্পীদের দিয়ে থিম সং ও র‌্যাপ সং নির্মাণ ও প্রচার করা হবে। বাস, লঞ্চ ও ট্রেনের সিট কভার এবং গণপরিবহণের স্টেশন ও কাউন্টারগুলোয় ব্যানার ও স্টিকার সাঁটানোর মাধ্যমে ইভিএম ব্র্যান্ডিং করা হবে। জনবহুল স্থান যেমন চায়ের দোকান, সেলুন, সুপারশপ ও ফার্মেসীতে ইভিএম সংক্রান্ত প্রচারনার ব্যবস্থা করা হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, জনমত জরিপ এবং জনপ্রিয় ও সর্বজন গৃহীত ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে ইভিএম-এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ইতিবাচক বিশ্লেষণধর্মী প্রচারণা চালানো হবে।

চলমান প্রকল্পের আওতায় যা থাকছে : ইসির দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প আগামী জুনে শেষ হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রচার চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ে তিনটি নাটক ও দুটি টিভিসি নির্মাণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টিভিতে সম্প্রচার করা হবে। এ সময়ে দুটি অ্যানিমেটেড কন্টেন্ট তৈরি করা হবে। ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে ইতিবাচক কন্টেন্ট প্রচার করা হবে। আগামী জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ইভিএমের নেতিবাচক দিকগুলো বিশ্লেষণ করে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে টকশো ও সাক্ষাতকার প্রচারের ব্যবস্থা করা হবে।

আটকে গেছে আরপিও সংশোধন : বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ইভিএম মেশিনে আঙ্গুলের ছাপের মাধ্যমে ভোটার শনাক্ত করে ব্যালট পেপার ইস্যু করা হয়।আঙ্গুলের মাধ্যমে ভোটার শনাক্ত করা না গেলে নির্বাচন কর্মকর্তা নিজের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে ওই ভোটারের ব্যালট ইস্যু করেন এবং এরপরই ওই ভোটার তার ভোট দিতে পারেন। কিন্তু নির্বাচন কর্মকর্তা কত শতাংশ ভোটারকে এভাবে ভোট দিতে সুযোগ দেবেন তা আইন ও বিধিতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই বলে সভায় জানান সিইসি। এজন্য আরপিওর ২৬ ধারায় একটি উপধারায় নির্বাচন কর্মকর্তাকে এক শতাংশ ভোটারের ব্যালট ইস্যুর বিধান রেখে সংশোধনের প্রস্তাব আনা হয়। ওই প্রস্তাবের উপর আলোচনায় একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, এক শতাংশ বিধান রাখা হলে তা নিয়ে মানুষের কাছে ভুল তথ্য যেতে পারে। আঙ্গুলের ছাপ না মিললেও সকল ভোটারই যাতে ভোট দিতে পারেন সেই ব্যবস্থা নিতে বিকল্প পথ খোঁজার পরামর্শ দেন তিনি। এরপরই এ বিষয়ে আরও আলোচনার পর সভার এজেন্ডা থেকে বাদ দেওয়া হয়। বৈঠকের এজেন্ডা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি ইসি সচিবও সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন।

LEAVE A REPLY