নিবন্ধন-নিয়ন্ত্রণ কিছুই নেই সরকারের

সারা দেশে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ কোনোটিই নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। এমনকি এ ধরনের কত সংখ্যক নৌযান চলছে, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের কাছে। অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ অনুযায়ী ১৬ অশ্বশক্তির বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিনচালিত নৌযান নিবন্ধন ছাড়া চলাচল করা নিষিদ্ধ।

বাস্তবতা হচ্ছে, জনবল সংকট ও কাঠামোগত সমস্যার কারণে এসব নৌযানকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে পারছে না নৌপরিবহণ অধিদপ্তর। আর এই কারণে ওইসব নৌযানের রুট পারমিটও দিচ্ছে না বিআইডব্লিউটিএ। স্থানীয় রাজনীতিক ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এসব ইঞ্জিনচালিত নৌযান অবৈধভাবে সারা দেশে চলাচল করছে।

সর্বশেষ রোববার পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতে যে ট্রলারটি ডুবেছে, সেটিরও নিবন্ধন ছিল না। ওই ঘটনায় বুধবার পর্যন্ত ৬৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।

সূত্রগুলো আরও জানায়, নিবন্ধন ও রুট পারমিট না থাকায় ইঞ্জিনচালিত এসব নৌযানে প্রশিক্ষিত চালক রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। এসব নৌযানের বছরভিত্তিক ফিটনেসও পরীক্ষা করা হয় না। প্রতিটি নৌযানে কতজন যাত্রী বহন করা যাবে, নেই সেই নির্দেশনাও।

ফলে প্রায়ই এ ধরনের ছোট নৌযানডুবিতে মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। নৌযানের নিবন্ধন না থাকায় ওই দায়দায়িত্ব নিতে নারাজ স্থানীয় প্রশাসন ও নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। দুর্ঘটনার পর কিছুদিন কড়াকড়ি আরোপ হলেও আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। এবারও করতোয়া নদীর ট্রলারডুবির ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌপরিবহণ অধিদপ্তর। সংস্থাটির শিপ সার্ভেয়ার ও ইঞ্জিনিয়ার এহসানুল হক ফকিরকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিতে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০২১ সালের আগস্টে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ডুবে যায়। ওই ঘটনায় অন্তত ২২ জনের প্রাণহানি ঘটে; যাদের মধ্যে নয়জনই শিশু। ওই ট্রলার ও বাল্কহেডের নিবন্ধন ছিল না। এ ঘটনার পর নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও মুখ্য পরিদর্শক ওই এলাকায় গিয়ে অনিবন্ধিত নৌযানের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। ওই ঘটনায় তদন্তও করা হয়। এরপর ওই এলাকার নৌযান চলাচলের ওপর এখন আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মো. নিজামুল হক জনবল সংকটকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, সারা দেশে এ সংস্থার ১৭ জন ইনস্পেকটর রয়েছেন; তাদের মধ্যে মাঠে থাকেন ১৪ জন। অথচ আমাদের নিবন্ধিত নৌযান রয়েছে ১৪ হাজার ৮০৫টি। এ হিসাবে প্রতি এক হাজার নিবন্ধিত নৌযানের বিপরীতে ইনস্পেকটর রয়েছেন একজন। একইভাবে সারা দেশে সার্ভেয়ার আছেন মাত্র ৬ জন। তিনি বলেন, সারা দেশে ১৮টি স্টেশন থেকে বেশিসংখ্যক নৌযান চলাচল করে। আমাদের জনবল দিয়ে ৪-৫টি স্টেশন মনিটরিং করা সম্ভব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে কত সংখ্যক নৌযান চলে, এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে আমরা পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে জরিপ কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছি।

নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১৪ হাজার ৮০৫টি। এর মধ্যে যাত্রীবাহী নৌযান ৮৪৭টি, ইঞ্জিনচালিত যাত্রীবাহী নৌকা ৪২২টি এবং স্পিডবোট ৭৭৮টি। এছাড়া মালবাহী ৩,৫৯১টি, বালুবাহী ৫,৩৩৬টি, ড্রেজার ১,৫২৮টি, পণ্যবাহী ১,০১৬টি, বার্জ ৫০৩টি, টাগবোট ১৬৩টি ও ফেরি ৪৪টি। বাকিগুলো অন্যান্য নৌযান।

নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১১ সাল থেকে সব ধরনের নৌযানকে নিবন্ধনের আওতায় আনার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর নৌযানের পরিসংখ্যানে একটি পাইলট প্রকল্পও নেওয়া হয়। এর আলোকে আরেকটি প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়। কিন্তু ওই প্রকল্প এখনো আলোর মুখ দেখেনি। সম্প্রতি ওই প্রকল্প অনুমোদন নিয়ে নৌপরিবহণ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ কোটি টাকা।

তবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের সক্ষমতা ও সম্ভাব্য ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সেটি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়। তবে সেটিও চূড়ান্ত হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, সারা দেশে অনিবন্ধিত নৌযান নিয়ন্ত্রণে সরকারের ত্বরিত পদক্ষেপ নেই। নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের জনবল বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি কয়েক বছর ধরে ঝুলে আছে। জনবল নিয়োগ না হওয়ায় নৌযান নিবন্ধন, ফিটনেস প্রদান ও মনিটরিং কার্যক্রমও এগোচ্ছে না। এছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশের ৮১ ধারা অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএ-এর ৪৭ জন কর্মকর্তাকে অনিবন্ধিত ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা খুব কমই ওই আইনের প্রয়োগ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

LEAVE A REPLY