লিলিয়া সাইরুস নামের এই প্রধানশিক্ষককে বলা হয়েছিল ইউক্রেনীয় পাঠ্যক্রমের কয়েকহাজার বই ধ্বংস করে ফেলতে-ছবি: বিবিসি
কিয়েভের দাবি মতে, ইউক্রেনীয় বাহিনী গত দুই সপ্তাহে ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চল রুশ সেনাদের দখল থেকে পুনরুদ্ধার করেছে। এত দিন শত্রুপক্ষের দখলে থাকাকালে সেসব অঞ্চলের বাসিন্দারা অস্ত্রের মুখে এমন অনেক কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, যা তাদের প্রাণ কেড়ে না নিলেও হূদয় বিদীর্ণ করেছে প্রতি মুহূর্তে।
গত ছয় মাস ধরে শত্রুর নিয়ন্ত্রণে থাকা ওই সব অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রুশ ভাষায় রুশ পাঠক্রম পড়াতে বাধ্য করা হয়েছে অনেক শিক্ষককে। তবে রুশপক্ষের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করায় নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, এমন উদাহরণও রয়েছে।
তেমনই একজন প্রধান শিক্ষিকা লিদিয়া তিলনা। তিনি জানান, রুশ পাঠ্যসূচি অনুসরণ করতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাঁকে আটক করে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে।
খারকিভ অঞ্চলের পূর্বাংশে বালাক্লিয়া ও ভোভচানস্ক এলাকা ঘুরে দেখতে গিয়ে একই ধরনের অনেক নির্যাতনের কাহিনি তুলে এনেছেন বিবিসির দুই প্রতিবেদক। শিক্ষকদের জবানি তুলে ধরে এই দুই প্রতিবেদক জানান, রুশ সেনারা এলাকা দখল করে প্রথমেই স্কুলের বইপত্র, ইউক্রেনীয় পতাকা, শিশুতোষ কার্যক্রম ধ্বংস করে দেয়। স্কুলের দেয়ালে থাকা বিখ্যাত ইউক্রেনীয় লেখক বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন প্রদর্শনীও নষ্ট করে দেওয়া হয়।
এসবের মধ্যেও অনেক শিক্ষক নিজেদের সম্পদ রক্ষায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছেন। তেমনই এক ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় দাঁড়িয়ে গর্বভরে অনেক কথা জানালেন প্রধান শিক্ষিকা লিলিয়া সাইরাস। তিনি জানান, রুশ পক্ষ তাঁকে দুই হাজার ২০০ বইয়ের একটি তালিকা দিয়ে বলেছিল, সেগুলো যেন ধ্বংস করে ফেলা হয়। কিন্তু তাঁর মনে আসে অন্য পরিকল্পনা। বইগুলো লুকিয়ে ফেলেন তিনি। নতুন পাঠ্যসূচিতে দৃশ্যত রুশ ইতিহাস, সাহিত্য, ভাষা জায়গা করে নিলেও সাইরাসের গোপন লাইব্রেরিতে ঠাঁই পায় ইউক্রেনীয় সেই সব বই, যেগুলো ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছিল রুশ পক্ষ।
দখলমুক্ত হয়ে সেই সম্পদের দিকে চেয়ে কেঁদে ফেলেন সাইরাস। বলেন, ‘আমার পড়শিরা আমাকে বলত, কেন এত দুর্ভোগ পোহাচ্ছ? রাশিয়া তো চিরদিনের জন্য এই জায়গা দখল করে নিয়েছে। ’ আশপাশের সবাই হতাশায় ভুগলেও এত দিন আশায় বুক বেঁধে ছিলেন সাইরাস। তাঁর আশা আজ সত্যি হয়েছে। রুশ দখলমুক্ত হয়েছে তাঁর এলাকা।
ছয় মাস ধরে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, পাঠ্যসূচি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য হওয়ার এমন আরো অনেক গল্প আছে ইউক্রেনীয়দের ঝুলিতে। বালাক্লিয়া ফাইভ স্কুলের উপপরিচালক ইনা মান্দ্রিকা বলেন, ‘স্কুলটার্মের শুরুতে আমাদের বলা হয়েছিল, আমরা যেন ছেলেমেয়েদের পড়াই যে ইউক্রেন রাশিয়ারই ভূখণ্ড ছিল, যার নাম ছিল মালোরুশিয়া (ছোট রাশিয়া)। ’ সেই নির্দেশ মানতে নির্ভীকভাবে অস্বীকার করেছিলেন তিনি। তাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি বটে, তবে তাঁকে পদ হারাতে হয়েছে। পদচ্যুত হয়ে তিনি অবশ্য চুপ করে বসে থাকেননি। কাজ চালিয়ে গেছেন নিজের মতো করে। বাইরে যখন বোমা পড়ছে তখন নিজের বাড়ির বেসমেন্টে প্রতি রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে ইউক্রেনীয় শিক্ষার্থীদের জন্য সিলেবাস তৈরির কাজ করেছেন তিনি। সেই সিলেবাস ছড়িয়ে দিয়েছেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
আরো তিক্ততার শিকার হয়েছেন ৬০ বছর বয়সী প্রধান শিক্ষিকা লিদিয়া টিনা। ৪০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন টিনা রুশ পক্ষের কথা না শোনায় তাঁকে ১৯ দিন আটকে রেখে মারধর করা হয়। তিনি ধরে নিয়েছিলেন, তাঁকে মেরে ফেলা হবে।
আতঙ্কের ভেতর দিয়ে গেছেন অভিভাবকরাও। সন্তানদের স্কুলে না পাঠালে তাদের এতিমখানায় নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিল রুশ শাসকরা। ভয় দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে নিয়ে সেখানেও পাহারা দিত রুশ সেনারা। সেই লোমহর্ষক দিনগুলো মনে করে ১৩ বছর বয়সী মিলেনা বলে, ‘এখন আমাদের লক্ষ্য কেবল টিকে থাকা। আমি আর অন্য কোনো স্বপ্ন দেখি না। ’ সূত্র : বিবিসি