থাইল্যান্ড-বাংলাদেশ: দুই দেশের যত মিল

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কার্যত বহুমুখী। এর মধ্যে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সরকারি, বেসরকারি খাত এবং সাধারণ জনগণের যোগাযোগ থাকতে হবে। মাঝে মাঝে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে যে তা সামগ্রিক সম্পর্কের শক্ত ভিত্তি তৈরি করে দেয়। মানুষ একে অন্যকে জানলে বা নিজেদের মধ্যে মিল খুঁজে পেলে সম্পর্ক আরো গভীর ও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে।

১৯৭২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অনেক আগে থেকেই থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ থেকেই দুই দেশের জনগণের মধ্যে ভ্রমণ, বাণিজ্য এবং সংস্কৃতি বিনিময় ছিল। এই ঐতিহাসিক যোগসূত্রের ছাপ অনেক দিক থেকে পাওয়া যায়। যেমন—থাই ও বাংলা লিপির ধরন ও সংখ্যা প্রায় একই রকম। থাই ও বাংলা নববর্ষ উভয়ে প্রতিবছর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে উদযাপন করে। প্রাচীন থাইল্যান্ডে ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী ক্যালেন্ডারও সম্ভবত বাংলা ক্যালেন্ডার দ্বারা প্রভাবিত ছিল।

সুবর্ণভূমি

আনন্দভূমিতে ভ্রমণ ইচ্ছুক বেশির ভাগ পর্যটকই সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সুবর্ণভূমি শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত ভাষা থেকে, যার অর্থ স্বর্ণভূমি। প্রাচীনকাল থেকে থাইরা মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই কেন্দ্রীয় সমভূমি অঞ্চলকে সুবর্ণভূমি বলে আসছে। সুবর্ণভূমি নাম ও ধারণার সঙ্গে বাংলাদেশের ‘সোনার বাংলা’র সুগভীর সম্পর্ক আছে। একই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মহামান্য রাজা ভূমিবল আদুল্যাদেজ ২০০৬ সালে থাইল্যান্ডের নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির এই নামকরণ করেন।

হাতি

হাতি থাইল্যান্ডের জাতীয় প্রাণী। থাই ইতিহাসে যুদ্ধ ও শান্তির ক্ষেত্রে হাতির বিশেষ ভূমিকা আছে। থাইদের বন্য হাতি পোষার প্রচলন শতবর্ষী। ১৮৬১ সালে রাজা মংকুট উপহার হিসেবে হাতি পাঠানোর আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস বুকাননকে চিঠি দিয়েছিলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া থাই হাতি লালনের জন্য প্রতিকূল হওয়ায় প্রেসিডেন্ট বুকাননের উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন চিঠির প্রতিউত্তরে প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করেন।

১৮ শতকে যখন থাইল্যাল্ড সিয়াম নামে পরিচিত ছিল, তখন জাতীয় পতাকা ছিল লাল জমিনের মাঝে সাদা হাতি। এই সাদা হাতি আসলে পুরোপুরি সাদা বর্ণের নয়। এর শরীরের বিশেষ কিছু অংশ হালকা বর্ণের। সাদা হাতি মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের জন্য বেঙ্গল টাইগার যেমন, থাইল্যান্ডের জন্য সাদা হাতি তেমনি তাৎপর্য বহন করে। বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল যেমন ‘বাংলার বাঘ’ নামে সুপরিচিত, তেমনি থাইল্যান্ডের জাতীয় ফুটবল দলকে ‘যোদ্ধা হাতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

পদ্ম ও শাপলা

থাইরা বুদ্ধদেবের মূর্তিতে পদ্ম ফুল অর্পণ করে। সাম্প্রতিককালে থাই ফুল বিক্রেতাদের ফুল সাজানোর প্রক্রিয়ায় থাই সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে পদ্ম ফুলের বিশেষ ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। কলাপাতার মতো পদ্মপাতাও খাবার মোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। জনপ্রিয় একটি থাই খাবার ‘খাও হর বাই বুয়া’ তৈরিতে ভাতকে সসেস, মাশরুম, পদ্মবীজ, গোজী বেরী, রসুনসহ পদ্মপাতা সিদ্ধ করে বিশেষভাবে মুড়িয়ে পরিবেশন করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলাও থাইরা বিভিন্ন ধরনের খাবার রান্নায় ব্যবহার করে থাকে। যেমন—নারকেলের দুধ দিয়ে ম্যাকারেল মাছের স্যুপ রান্নায় বা যেকোনো ধরনের মাংস ভাজার সময় শাপলা ফুলের ডাঁটা ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া বেশ কিছু ঝাল ভর্তা খাবারের সঙ্গে শাপলা ফুলের কচি ডাঁটা খেতে দারুণ মুখরোচক। বাংলাদেশেও প্রায় একই রন্ধন প্রক্রিয়ায় শাপলা খাওয়া হয়।

নৌকাবাইচ

থাই উৎসবের মধ্যে নৌকাবাইচ অন্যতম। বর্ষাকালে যখন নদীগুলো পানিতে টইটম্বুর থাকে (অক্টোবর-নভেম্বর) তখন এই বার্ষিক উৎসবের আয়োজন করা হয়। নৌকা তৈরি, নৌচালন মহড়া এবং জনসাধারণের আনন্দ-উল্লাস সবার মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি মজবুত করে। আর জুন থেকে অক্টোবর মাসে অর্থাৎ বর্ষাকালে বাংলাদেশে নৌকাবাইচ উদযাপিত হয়।   

আম

থাইল্যান্ডে গ্রীষ্মকাল এসেছে কি না বোঝা যায় আমের উপস্থিতি দেখে। হরেক প্রজাতির আমের মধ্যে ‘নাম ডকমাই’ আর ‘ওক রং’ সবচেয়ে জনপ্রিয়। এই আমগুলো নারকেলের দুধ আর তিলের বীজ দিয়ে তৈরি ‘স্টিকি রাইস’-এর সঙ্গে খাওয়া হয়।

বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চল হচ্ছে আমের সবচেয়ে বড় উৎস। ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, হিমসাগর, ক্ষীরসাপাতি, আশ্বিনি, কিষানভোগ, মোহনভোগ ইত্যাদি কত আম। মৌসুমে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের কাছে উপহার হিসেবে আম পাঠানো হয়। এখন এটিকে বলা হচ্ছে ‘আম কূটনীতি’।

খাও (ভাত) এবং প্লা (মাছ)

বাংলাদেশে একটি প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে—মাছে ভাতে বাঙালি। কারণ মাছ ও ভাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। একইভাবে থাইল্যান্ডেও প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছ। সুগন্ধী জেসমিন চাল থাইল্যান্ডে খুবই জনপ্রিয়। দেশটির মূল ভূমিতে প্রচুর পরিমাণ জেসমিন ধানের চাষাবাদ হয়। দেশটির উত্তর-পূর্বদিকে স্টিকি রাইসের (আঠালো ভাত) চাহিদা বেশি। মাঝে মাঝে থাইরা মাছ লবণের মধ্যে রেখে শুঁটকি (প্লা রা) তৈরি করে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভাসে প্লা রা-এর ব্যবহার অপরিহার্য। যেমন—পেঁপের সালাদ। বাংলাদেশেও একই ধরনের খাবার উপাদান জনপ্রিয়।

থাই বর্ণমালা

থাই বর্ণমালায় ৪৪টি ব্যঞ্জনবর্ণ ও ২২টি স্বরবর্ণ রয়েছে। বর্ণমালার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে শব্দ গঠনের ক্ষেত্রে থাই ও বাংলা ভাষায় ব্যঞ্জনবর্ণ ও স্বরবর্ণের সংমিশ্রণ প্রায় একই রকম। কিছু থাই অক্ষরে বাংলা বর্ণের চিহ্ন রয়েছে এবং স্বরবর্ণগুলো বাংলার অনুরূপে ব্যঞ্জনবর্ণের আগে, নিচে বা ওপরে স্থাপন করা হয়।

LEAVE A REPLY