শিল্পে ৫৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ খেলাপি

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে শিল্পঋণে খেলাপি ৫৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে প্রায় ৩০ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকে ২৪ দশমিক ৬২ শতাংশ আছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ২২ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং ১০টি ব্যাংক ও ২১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১৫ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ বিতরণে যথাযথ নিয়ম মানা হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঘুরেফিরে ঋণ পাচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় ব্যাংকের টাকা ফেরত দেন না। আবার কেউ কেউ নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে বিদেশে পাচার করছেন। সাধারণত এসব টাকা আর ফেরত আসে না। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত শিল্পঋণে খেলাপির অঙ্ক ৫৮ হাজার ১৪৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা গত মার্চে ছিল ৫২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা বা ১১ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিল্প খাতে খেলাপি ৫৮ হাজার ১৪৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা ব্যাংক খাতে মোট খেলাপির ৪৬ দশমিক ৪১ শতাংশ।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শিল্প খাতে ৫৯টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪৭ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা।

আর ৩২টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শিল্পে খেলাপি ১০ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির হার সবচেয়ে বেশি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে। শিল্পে খাতটির ঋণ ৩৫ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। খেলাপি হয়ে গেছে ১০ হাজার ৫২৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

বিশেষায়িত তিন ব্যাংকের শিল্পে ঋণ ৪ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের শিল্পে ঋণ ৮৬ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ১৯ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এছাড়া ১০টি ব্যাংক ও ২১টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শিল্পঋণে খেলাপি ঋণের হার ১৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা, যা তিন মাস আগে ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে শিল্পঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ।

এদিকে শিল্পঋণ বিতরণ বাড়লেও আদায়ের হার অত্যন্ত নাজুক। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আদায় কমেছে ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণ আদায় হয়েছে ৮৮ হাজার ২৩১ কোটি টাকা, যা তিন মাস আগে ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে শিল্প খাতে ঋণ আদায় কমেছে ১৩ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিতরণ করা শিল্পঋণের মধ্যে ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এ অঙ্ক তিন মাস আগের তুলনায় ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের মার্চ শেষে বকেয়া ছিল ৬ লাখ ২৮ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। শিল্প খাতে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণের অঙ্ক ৮৯ হাজার ২৩২ কোটি টাকা, যা তিন মাস আগে ছিল ৯০ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, শিল্প খাতে ছোট প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানের খেলাপির হার বেশি। কারণ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হওয়ার পরও বারবার ঋণ পাচ্ছে। তাই এ খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। এছাড়া পুনঃতফশিল ও পুনর্গঠন সুবিধার কারণে এ খাতের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ খেলাপি ঋণের চেয়ে অনেক বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি হলে নতুন করে ঋণ পাওয়ার কথা নয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি পুনঃতফশিলের ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে ছেড়ে দিয়ে একটা উদার নীতি দেখিয়েছে। এতে খেলাপি কমার চেয়ে আরও বাড়বে। এছাড়া আইনি প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ার কারণে খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংকগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় আদায়ের ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখায় না। তাই এ প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। আর আইনি প্রক্রিয়া সহজ হলেই খেলাপি ঋণ আদায় বাড়বে।

LEAVE A REPLY