পুরো আসনের ভোট বন্ধ

দিনভর কেন্দ্রে কেন্দ্রে একতরফা প্রভাব বিস্তার ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে গাইবান্ধা-৫ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বেশিরভাগ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরুর পর থেকেই একজনের ভোট আরেকজন দিয়েছেন এবং পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। পাশাপাশি গোপনকক্ষে একাধিক ব্যক্তির উপস্থিতি ও সরকারদলীয় প্রার্থীর এজেন্টদের নিয়মের বাইরে গিয়ে তৎপরতা চালানোর অভিযোগ এনে পুরো আসনের ভোট বন্ধ করা হয়।

ভোটকেন্দ্রে স্থাপিত সিসি ক্যামেরার সরাসরি লাইভ ফুটেজ ইসিতে বসে দেখার পর ভোট বন্ধের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বুধবার এ উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরুর ছয় ঘণ্টা পর দুপুর সোয়া ২টার দিকে সব কেন্দ্রের ভোট একসঙ্গে বন্ধে ইসির সিদ্ধান্তের কথা জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। বিকালে এ উপনির্বাচনের ভোট বন্ধের বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্ত রিটার্নিং কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়। বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার সময় নির্ধারিত ছিল।

রিটার্নিং অফিসারকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সিসি ক্যামেরায় সরাসরি তদারকিতে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়ম ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতায় গাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচনের সব ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। 
ভোটগ্রহণ বন্ধের সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কাছে মনে হয়েছে ভোটগ্রহণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

কোনো একটি পক্ষ বা কোনো একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রভাবিত করতে পারছেন। ফলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে ইমপার্শিয়ালি ফেয়ারলি ভোটগ্রহণ হচ্ছে না। কয়েক ধাপে ৫১টি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিতের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এসব কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধের পর আইন-কানুন পর্যালোচনা করে দেখেছি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ৯১ অনুচ্ছেদে সঠিক ও স্বচ্ছভাবে ভোট না হলে নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া আছে। সেই অনুযায়ী, পুরো নির্বাচনি এলাকার (গাইবান্ধা-৫) ভোটগ্রহণ কার্যক্রম আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। এই সিদ্ধান্ত রিটার্নিং অফিসারকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওখানে এখন আর ভোট হচ্ছে না। পরে আমরা দেখব বিধিবিধান অনুযায়ী কী করতে হবে। আমরা কমিশন বসে আইন-কানুন পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। কোন প্রার্থী বা কাদের কারণে ভোট বন্ধ করতে হয়েছে তা তদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি। 

আরপিওর ৯১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যদি সন্তুষ্ট হয় যে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিসঙ্গত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগ নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে ক্ষেত্রমত বা সম্পূর্ণ নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোটগ্রহণসহ নির্বাচনি কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে। 

ইসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অনিয়মের অভিযোগে দুপুর পর্যন্ত ৫১টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়। ১৪৫টি কেন্দ্রের মধ্যে বাকিগুলোর ভোটে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে না বিবেচনায় পুরো আসনের ভোট বন্ধ করা হয়েছে। এ ঘটনায় শিগগিরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। ওই কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া এ আসনের ভোটগ্রহণে আরেকটি তারিখ নির্ধারণ করা হবে। বিদ্যমান প্রার্থীরাই ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন। অনিয়মের অভিযোগে যে ৫১টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে সেগুলোর সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এনে বিশ্লেষণ শুরু করেছে ইসি। এতে বেশ কিছু নির্বাচন কর্মকর্তার অনিয়মে জড়িত হওয়ার চিত্র রয়েছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় দেখা গেছে। সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণে নির্বাচনি মাঠে এক হাজার ২৬৫ জন পুলিশ, র‌্যাবের ৯টি টিম ও ৪ প্লাটুন বিজিবির সদস্য মাঠে ছিলেন। এছাড়া সেখানে জুডিশিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োজিত ছিল। 

ভোটগ্রহণ চলাবস্থায় একটি আসনের পুরো ভোট বন্ধের ঘটনা নিকট-অতীতে ঘটেনি বলে জানান নির্র্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা। তারা জানান, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচন বন্ধের নজির রয়েছে। জাতীয় সংসদের কোনো উপনির্বাচনের এটাই সম্ভবত প্রথম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সাবেক যুগ্মসচিব মিহির সারওয়ার মোর্শেদ জানান, এভাবে পুরো আসনের ভোট বন্ধের ঘটনা ঘটেনি। তবে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সময়ে স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের মুখে নারায়ণগঞ্জের একটি আসনের একটি উপজেলায় ইসি ভোটগ্রহণ করতে পারেনি। 

সরেজমিন ইসিতে গিয়ে দেখা যায়, গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ১৪৫টি ভোটকেন্দ্রের ৯৫২টি ভোটকক্ষে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার কথা ছিল। অনিয়মের কারণে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ধাপে ধাপে ৫১টি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করে ইসি। বেলা সাড়ে ১২টার পর সিইসির কার্যালয়ে নির্বাচন কমিশনারদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান ছাড়া বাকি তিনজন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। বেলা সোয়া ২টার দিকে সিইসি ভোটগ্রহণ বন্ধে ইসির সিদ্ধান্তের কথা জানান। এর আগে সিইসি ও তিনজন নির্বাচন কমিশনার ইসির কন্ট্রোল রুমে বসে সিসি ক্যামেরায় ভোটগ্রহণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। সেখানে বসেই বেলা সোয়া ১২টার মধ্যে ৪৩টি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করেন তারা। পরে তারা সিইসির কার্যালয়ে চলে যান। পরে আরও ৮টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করা হয়। সবমিলিয়ে সরাসরি অনিয়মের অভিযোগে ৫১টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করে ইসি। 

সিসি ক্যামেরায় দেখা নির্বাচনে অনিয়মের কথা তুলে ধরে সিইসি বলেন, আমরা সহকর্মীরা সকাল আটটা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভোটগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা কেউ মনিটরিং কক্ষ ত্যাগ করিনি। অনিয়ম এবং অবৈধ কাজগুলো বেশ মোটা দাগে হয়েছে। যার ফলে আমরা প্রথমে তিনটি ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিই। এরপর ১৬টি কেন্দ্র এবং তৃতীয় দফায় আরও ১২টি কেন্দ্র বন্ধ করেছি। আমরা চতুর্থ দফায় কয়েকটি এবং সর্বশেষ আরও তিনটিসহ মোট ৪৩টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দিয়ে পর্যবেক্ষণ কক্ষ ত্যাগ করেছি। তখন আমরা অফিসারদের মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দিয়ে এসেছি। দেখা গেল, কতগুলো কেন্দ্রে সিসিটিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে আমরা তথ্য সংগ্রহ করতে পারছিলাম না। কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষাপটে পরে আমরা আরও সাতটি ভোটকেন্দ্র করি। এছাড়া রিটার্নিং অফিসারও একটি ভোটকেন্দ্রের ভোট বন্ধ করেন। সিইসি বলেন, বিষয়টি আমরা কমিশনের সব সদস্য বসে পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করেছি। আমরা নিশ্চিত হই-৫০টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ হয়ে গেলে বাকি যেসব কেন্দ্র থাকে সেখানকার পরিবেশ বিচার করে সঠিক মূল্যায়ন হবে না।

একটি আসনে ভোট করতে গিয়ে এমন অবস্থা হলে ৩০০ আসনে ভোটের সময়ে কী পরিস্থিতি হবে-এমন প্রশ্নের উত্তরে সিইসি বলেন, এটা সময় বলে দেবে। এখন একটি আসনে ভোট সঠিক হচ্ছে না বলে ৩০০ আসনে হবে না সেটি বলা সমীচীন হবে না। এই নির্বাচন থেকে আমরা কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে পারব। আগামী নির্বাচনগুলো যেভাবে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে করতে পারি তার একটি নির্দেশনা এখানে পাওয়া যাবে।

ইভিএমে ভোটগ্রহণের পরও এমন অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিইসি বলেন, এটা ইভিএম-এর বিষয় নয়, এটি হচ্ছে হিউম্যান এলিমেন্ট। এখানে আমরা যান্ত্রিক বা মেকানিক্যাল কোনো সমস্যা দেখিনি। ভোটে ইভিএম কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি। ভোটকেন্দ্র প্রিসাইডিং অফিসারসহ নির্বাচনি কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। 
গত ২৩ জুলাই জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বি মিয়া নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে ওই আসনটি শূন্য হয়। ওই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. মাহমুদ হাসান রিপন (নৌকা প্রতীক)। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির এইচএম গোলাম শহীদ রঞ্জু (লাঙ্গল), বিকল্পধারা বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর আলম (কুলা), স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ (আপেল) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান (ট্রাক) এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তারা সবাই সরকারি দলের প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার ও অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গাইবান্ধা-৫ সংসদীয় আসনে ১৪৫টি কেন্দ্রে ৯৫২টি ভোটকক্ষ রয়েছে। প্রতি ভোটকক্ষ ও কেন্দ্র মিলিয়ে এক হাজার ২৪২টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। এসব সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সরকারি ইসি সচিবালয়ের বড় পর্দায় দেখানো হয়। এতে দেখা যায়, সকাল থেকে চর এলাকার ৩১টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭টি কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ আসছিল। বাকিগুলোর ফুটেজ আসেনি। ভোটগ্রহণ চলা অবস্থায় অন্য আরও কয়েকটি কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আসা বন্ধ হয়ে যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, সেগুলোর সংযোগ তার ছিঁড়ে ফেলা হয়।

সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আরও দেখা গেছে, অনেক কেন্দ্রে ভোটার আসার পর ইভিএমে তাদের আঙুলের ছাপ দিয়ে ব্যালট ইস্যুর পর তাকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। কখনো সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, কখনো পোলিং কর্মকর্তা আবার কখনো এজেন্টরা ভোট দিয়ে দিচ্ছেন। আবার কখনো কখনো ভোটারের সঙ্গে দুই থেকে তিনজন গোপন কক্ষে প্রবেশ করছেন। তারা ওই ভোটারকে নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করছেন। আবার কিছু কিছু কেন্দ্রে দেখা গেছে, ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন তা অন্যজন সামনে থেকে নিশ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া কেন্দ্রে সরকারদলীয় প্রার্থীর এজেন্টদের শরীরে নৌকা প্রতীক সংবলিত টি-শার্ট ও শাড়ি পরা ছিল। সূত্র আরও জানায়, অনিয়মের অভিযোগে যে ৫১টি কেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে, সেগুলোর দিনভর ভোটগ্রহণের ফুটেজ সংগ্রহ করেছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। ওই সব ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। 

ভোটগ্রহণ শুরু থেকেই অনিয়ম দেখতে পান সিইসি ও তিনজন কমিশনার। দুপুর ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে সিইসি বলেন, আমরা প্রথম থেকে লক্ষ করেছি ভোটগ্রহণে অনিয়ম হচ্ছে। অনেক কেন্দ্রে আমরা গোপন ভোটকক্ষে অবৈধ অনুপ্রবেশ লক্ষ করেছি। অবৈধভাবে প্রবেশ করে ভোটারদের ভোট প্রদানে সহায়তা করছে অথবা বাধ্য করছে। এটা আমরা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ করেছি। আমরা দেখেছি সম্ভবত পোলিং এজেন্টের গায়ের গেঞ্জিতে নির্বাচনের প্রতীক ছাপানো ছিল। মেয়েদের একই রকমের শাড়ি বা ওড়নায় প্রতীক ছাপানো ছিল; যেটা নির্বাচন আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি। 

সূত্র জানায়, ভোটগ্রহণ শুরু থেকে অনিয়মের চিত্র দেখতে পান সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা। সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা গাইবান্ধার স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে দফায় দফায় ফোনে আলাপ করেন। একপর্যায়ে ফোনে সিইসি কোনো এক কর্মকর্তাকে ভোটকেন্দ্র বন্ধের নির্দেশ দেন। ভোট চলা অবস্থায় নির্বাচন বন্ধ করা হলে নির্বাচন কর্মকর্তারা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারেন- এমন কারণ দেখানো হলে সিইসি মোবাইল ফোনেই কেন্দ্র বন্ধের কড়া নির্দেশনা দেন। এরপর থেকে কেন্দ্র বন্ধ হতে শুরু করে। 

চার ঘণ্টার ভোটগ্রহণ পরিস্থিতি দেখেই সিইসি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে মন্তব্য করেন। বেলা ১২টার দিকে তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে অবশ্যই ভোটকেন্দ্রের ভেতরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে। মানে যারা-ভোটাররা কিছু অনিয়ম গোপন কক্ষে অনধিকার প্রবেশ বা আইনভঙ্গ করে ভোট দিয়ে দিতে আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। তখন তিনি বলেন, চাকরিবিধি অনুযায়ী কি ব্যবস্থা নেব দেখছি। 

ডিসি-এসপি, রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে নিজে কথা বলেছেন উল্লেখ করে সিইসি জানান, কমিশন যেসব কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে সেগুলো সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন স্থগিত করে দেন সেই নির্দেশনা দিয়েছি। আইন না মেনে ভোটকক্ষে অনুপ্রবেশকারীদের ডাকাত ও দুর্বৃত্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা আইন মানেন না তারা দুর্বৃত্ত। আমরা যদি সংস্কৃতি ডেভেলপ করতে না পারি, নির্বাচন কমিশন এখানে বসে বসে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারবে না। 

চার প্রার্থীর ভোট বর্জনের ঘোষণা : গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনের উপনির্বাচনে চার প্রার্থী ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণ স্থগিত করার আগেই কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগে তারা ভোট বর্জন করেন। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাঘাটা উপজেলার বগেরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারা ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। ভোট বর্জনকারী প্রার্থীরা হলেন-জাতীয় পার্টির এএইচএম গোলাম শহীদ রনজু (লাঙ্গল), বিকল্পধারার জাহাঙ্গীর আলম (কুলা), স্বতন্ত্র নাহিদুজ্জামান নিশাদ (আপেল) ও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান (ট্রাক)। 
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শহীদ রনজু জানান, তাদের কর্মী ও সমর্থকদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে। এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে কেন্দ্র দখল এবং জাল ভোট দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি রনজু আরও জানান, ইভিএম-এ জালিয়াতিসহ নানা কারণে একযোগে তারা চার প্রার্থী ভোট বর্জন করছেন। 

এদিকে জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহজাহান খান আবু জানান, নির্বাচন কমিশন প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সিসিটিভি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে কেন্দ্র দখলে নেয়। এছাড়া ভোটকেন্দ্রে জাতীয় পার্টির এজেন্টকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মইনুল হাসান সাদিক বলেন, এ উপনির্বাচন প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে কী করবে? এ জন্যই বিএনপি নির্দলীয় সরকারের পক্ষে আন্দোলন করছে। এছাড়া ইভিএমে ভোট গ্রহণযোগ্য নয়। রিটার্নিং অফিসার ও রাজশাহী আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানে আমার কথা বলার সুযোগ নেই।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন। তিনি বলেন, তার কোনো কর্মী বা সমর্থক অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেয়নি এবং বাধাও দেয়নি।

বিকালে সাঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মাহমুদ হাসান। তিনি স্থগিত কেন্দ্রগুলো বাদ দিয়ে বাকি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার দাবি জানান। মাহমুদ হাসান বলেন, উপনির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। ভোটাররা উৎসবমুখর পরিবেশে প্রায় সারাদিন ভোট দিয়েছেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ হয়েছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে বেলা ৩টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলেছে। স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কর্মকর্তারা কারও কাছে কোনো অভিযোগ দেননি। অথচ যৌক্তিক কারণ ছাড়াই নির্বাচন কমিশন বেশ কিছু কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করে, যা সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছে।

আ.লীগের বিক্ষোভ : বিকাল ৪টার দিকে বোনারপাড়ার সাঘাটা উপজেলা পরিষদ চত্বরে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করেন নৌকা সমর্থকরা। পরে একসঙ্গে হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে সাঘাটা-বোনারপাড়া সড়কের চৌমাথা মোড়ে অবস্থান নেয় নেতাকর্মীরা। সেখানে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়েও প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেন নেতাকর্মীরা। এ সময় সেখানে আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশন সব যাচাই-বাছাই না করে এই ভোট বন্ধ করে দিয়েছেন। ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান জিএম সেলিম পারভেজের নেতৃত্বেও বিক্ষোভ হয়েছে। তার অনুসারীরা টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে।

LEAVE A REPLY