ব্যাংকিং খাতের সংকট টেনে আনবে মন্দা

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ

মুষ্টিমেয় অসাধু কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের দাপট এবং আধিপত্যের কারণে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি খেলাপি ঋণের প্রসার ঘটাচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা না থাকায় সোনালী, বেসিকসহ আরো কিছু ব্যাংকের বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। আর খেলাপি ঋণের বিস্তার ব্যাংকগুলোর ভিত্তিকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করছে। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ব্যাংকগুলোর উপর তদারকি ও নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে ২০২২ সালের আর্থিক খাতে নোবেল বিজয়ী সবাই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেছেন। তারা বলছেন, ব্যাংকিং খাতের সংকট অর্থনৈতিক মন্দাকে টেনে আনবে। আমাদের জন্য এটা শিক্ষনীয় বিষয়।

এ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকাররা খুব বেশি মনোযোগী নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ বিষয়ে খুব বেশি চাপ দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক পলিসিগুলো সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়, সেগুলো পরিপালন হয় না। ঋণখেলাপিরা যেসব সুযোগ চায়, সেটাই আবার দেয়া হয়। খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে না গিয়ে এভাবে বারবার সুবিধা ও ছাড় দেয়া মোটেও ঠিক হচ্ছে না। এর ফলে তাদের মধ্যে এ ধারণা জন্মেছে, চাইলেই সুবিধা পাওয়া যায়। এতে ঋণখেলাপিরা আরো উৎসাহ পাচ্ছে। তারা মনে করছে, আবার কয়েকদিন পর আরো সুবিধা পাওয়া যাবে।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাংকাররাও খুব বেশি সচেষ্ট হচ্ছে না খেলাপি আদায়ে। ব্যাংকগুলোও কোনো যাচাই বাচাই ছাড়াই ঋণ দিয়ে দিচ্ছে। আবার তদন্ত করে কোনো কিছু পাওয়া গেলেও ব্যবস্থা নেয়া হয় না, এটাও অত্যন্ত দুঃখজনক। বাংলাদেশ ব্যাংক শক্ত না হলে, সুশাসন প্রতিষ্ঠান করা না গেলে এবং সর্বোপরি সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি থাকলে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। এছাড়া ব্যাংকের সিংহভাগ অর্থই যাচ্ছে বড় বড় ঋণগ্রহিতাদের কাছে। আর মাঝারি, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঋণ চেয়েও পাচ্ছে না।

সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলোতে এখনো কিছু অসাধু ব্যাংকার ঋণখেলাপিদের সহযোগিতা করছে। তাদের সহযোগিতায় ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকও এ বিষয়ে খুব বেশি নজর দিচ্ছে না। কিছু ব্যাখ্যা চায়, চিঠি দেয়। কিছুদিন পর আবার সন্তুষ্টি প্রকাশ করে ছেড়ে দেয়া হয়। এতে ব্যাংকিং খাতে আরো অস্থিরতা বাড়ছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো অনেক কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া খেলাপি এক লাখ ২৫ হাজার বলা হলেও বাস্তবে অনেক বেশি। কারণ ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন, অবলোপন, কোর্টে রিট করা ঋণসহ বেশ কিছু তথ্য যোগ হয়নি। এটি যুক্ত হলে খেলাপি দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এগুলো কমাতে হলে কঠিনভাবে আইন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর আরো বলেন, হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেয়া কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ বা নীতিগুলো হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং ব্যাংকের জন্য মঙ্গলজনক। যাতে খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল, প্রভিশন ঘাটতি কমে আসে। এসব সমস্যা সমাধানে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা উচিত। এর আগেও খেলাপি সমস্যার সমাধান হয়েছে ব্যাংকিং কমিশনের মাধ্যমে।

LEAVE A REPLY